বাতাসের মান যাচাইয়ের উদ্যোগ সরকারের
প্রকাশিতঃ 6:05 pm | May 14, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
বাংলাদেশ ও রাজধানী শহর ঢাকায় বায়ুদূষণের সমস্যাটি নতুন নয়। বছর বছর বায়ুর মানের অবনতি হচ্ছে। আইকিউএয়ারের হিসাবে, ২০১৬ সালে ঢাকার বায়ুমান সূচক ছিল ১৫০, যা ২০২৩ সালে ১৭১-এ উঠে যায়। মানে হলো বায়ুদূষণ বেড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা প্রায়ই ১ নম্বরে থাকে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া আওয়ামী সরকারের আমলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে খুব একটা জোর দেওয়া হয়নি। নামকাওয়াস্তে অভিযান চালানো,কিছু চিঠি–চালাচালি, কয়েকটি গাড়ি দিয়ে পানি ছিটানো এবং নির্মল বায়ু প্রকল্পের নামে নানা অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়া তেমন কিছু করতে দেখা যায়নি। বরং আওয়ামী লীগ সরকার বায়ুদূষণকারী বহু পুরোনো যানবাহন ঢাকায় চলতে দিয়েছে ‘রাজনৈতিক স্বার্থে’। নিম্নমানের জ্বালানি তেল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। উন্নয়নকাজ চলার সময় বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো পদক্ষেপও দেখা যায়নি।
তবে এবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের বাতাসের মান যাচাইয়ের উদ্যোগ নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। তিন সিটি করপোরেশনের সড়কের পাশের এলাকাগুলোর বাতাসের গুণগত মান পরীক্ষা এবং যানবাহনের কারণে কী পরিমাণ বায়ুদূষণ হচ্ছে সেটি জানার জন্য ২৪টি মনিটরিং স্টেশন স্থাপন করা হবে। এসব মনিটরিং সরবরাহসহ স্থাপনে খরচ হবে শতকোটি টাকারও বেশি। ‘দ্য প্রজেক্ট ফর দ্য ইমপ্রুভমেন্ট অব ইকুপমেন্ট ফর দ্য এয়ার পলুশন মনিটরিং’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। গত ২০ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদনও দেওয়া হয়।
জানা যায়, ঢাকার রাস্তায় বের হলেই দেখা যায়, খোঁড়াখুঁড়ি অথবা নির্মাণকাজ চলছে; সেখানে ধুলাবালু যথেচ্ছভাবে ছড়াচ্ছে। রাস্তায় বের হলেই দেখা যায়, বহু পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় বাস, লেগুনার মতো যানবাহন কালো ধোঁয়া ছেড়ে চলাচল করছে। রাস্তায় বের হলেই দেখা যায়, জমা করে বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) তথ্যানুযায়ী, ঢাকায় বায়ুদূষণের বড় উৎস নির্মাণকাজ। এরপর রয়েছে ইটভাটা ও কারখানা, যানবাহন, আন্তর্দেশীয় দূষিত বায়ু, রান্নার চুলা এবং বর্জ্য পোড়ানো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম ও তাঁর সহকারীরা ১৩ বছর ধরে ঢাকার বাতাসের ক্ষতিকর উপাদানগুলোর পরিমাপ করে আসছেন। তাঁরা বায়ুর মান পরিবীক্ষণযন্ত্রের সাহায্যে বাতাসের অবস্থা দেখেন। পাশাপাশি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের (নাসা) উপগ্রহ থেকে পাওয়া উপাত্তের সহায়তা নেওয়া হয়। তাঁদের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার বাতাসে অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদানের সঙ্গে চারটি উপাদানের আশঙ্কাজনক উপস্থিতি রয়েছে—নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড, অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা, সালফার ডাই–অক্সাইড ও ব্ল্যাক কার্বন।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সালে বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে কমপক্ষে ২ লাখ ৩৬ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এ ছাড়া সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জন মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ২৫৮ শিশুর কথা বলা হয়েছে। বায়ুদূষণে বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মস্তিষ্ক বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। বলা হচ্ছে, বায়ু ও সিসা দূষণসহ বিভিন্ন দূষণ শিশুদের আইকিউ হ্রাসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
একনেক সূত্র জানায়, ‘দ্য প্রজেক্ট ফর দ্য ইমপ্রুভমেন্ট অব ইকুপমেন্ট ফর দ্য এয়ার পলুশন মনিটরিং’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে চলতি বছরের মার্চ থেকে ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত। তিন বছর মেয়াদি এ প্রকেল্পর ব্যয় ধরা হয়েছে ১০৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এতে সরকার জোগান (জিওবি) দেবে ৩৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা। আর জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) অনুদান দেবে ৬৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। প্রকল্পটি ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ চট্টগ্রাম শহরে বাস্তবায়িত হবে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে রাস্তার পাশের এলাকাগুলোতে ১৯টি কন্টিনিউয়াস এয়ার মনিটরিং স্টেশন (সিএএমএস) এবং চট্টগ্রাম শহরে ৫টি মনিটরিং স্টেশন স্থাপন করা হবে। এ প্রকল্পের আওতায় মনিটরিং স্টেশন স্থাপন করা হবে মোট ২৪টি।
গত ২০ এপ্রিলের একনেক সভা শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণের জন্য বর্তমানে ৩১টি স্টেশন রয়েছে। সেখান থেকে বায়ুদূষণের পরিমাণ জানা যায়। এবার রাস্তার পাশে মনিটরিং স্টেশন স্থাপন করা হবে। যানবাহনের কারণে কতটুকু, কী পরিমাণ বা কীসের কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে সেটি আলাদাভাবে জানা যাবে এসব স্টেশনের মাধ্যমে।
এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের রাস্তার পাশের এলাকাগুলোতে বাতাসের গুণগত মান পরীক্ষা করা এবং পাশাপাশি এসব এলাকার সড়কে যানবাহনের কারণে কী পরিমাণ বায়ুদূষণ হচ্ছে সেটি পরিমাপ করা। আর প্রকল্পের লক্ষ্য হলো- বায়ুদূষণের উৎস ও মাত্রা চিহ্নিত করা। বায়ুদূষণ কমানোর জন্য কার্যকর নীতিমালা এবং বাস্তবায়ন কৌশল প্রণয়ন করা। একই সঙ্গে বায়ুদূষণ সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো এবং আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা।
কালের আলো/এমএএইচএন