স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার গণমুখী কর্মযজ্ঞে প্রশংসায় মেতেছে নেটিজেনরা, উজ্জ্বল হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি

প্রকাশিতঃ 11:02 pm | April 19, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পটপরিবর্তনের পর বল প্রয়োগের চিন্তা বা ধ্যানধারণা থেকে সরে এসেছে বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশ ক্রমশ গণমুখী হয়েছে। বিচারপ্রার্থীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদানের মাধ্যমে পুলিশ সাধারণ মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন করার প্রাণান্তকর প্রয়াস নিয়েছে। আর এসবের নেপথ্যে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো.জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। মাত্র মাস কয়েক আগেও নানা ইস্যুতে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে সরব ছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু নিজের গণমুখী চরিত্রের মাধ্যমে সমালোচকদের তিনি জবাব দিচ্ছেন একদিন-প্রতিদিন। জয় করে নিয়েছেন দেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়।

কোন রকম হাঁকডাক না মেরে, পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তা আইজিপি বা ডিএমপি কমিশনারকে সঙ্গে না নিয়ে রাজধানীর থানায় থানায় ছুটে চলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের এই উপদেষ্টা। ধারাবাহিকভাবে পরিদর্শন করছেন প্রতিটি থানা। থানার সেবাপ্রত্যাশীদের দুয়ারে গিয়ে তাদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। কে কী কাজে এসেছেন সেটি জানতে চাচ্ছেন। নিজের পক্ষ থেকে কোন সহযোগিতার সুযোগ থাকলে সেটি করতেও কুণ্ঠবোধ করছেন না। পাশাপাশি চলার পথেই কোন ভুক্তভোগীর অনুরোধে গাড়ি থামিয়ে সরাসরি কথা বলছেন তিনি। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে সংশ্লিষ্ট থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সরাসরি বিষয়টি দেখার নির্দেশ দিচ্ছেন। এসবে কোন রকম ভনিতা বা আদিখ্যেতা নেই যেন!

একেবারেই সরল-সহজ ও স্বাভাবিক মন-মননের অধিকারী এই উপদেষ্টার সঙ্গে সাধারণ মানুষ কথা বলতে পারছেন স্বাভাবিকভাবেই, ‘ওয়ান টু ওয়ান।’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিহাসে যা একেবারেই বিরল! অতীতে কোন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জনবান্ধব এমন চরিত্রে দেখা যায়নি। শুধুমাত্র মিডিয়া মার্চ করতেই লোক দেখানো থানা উদ্বোধনের পরপরই দাম্ভিকতা আর অহমিকায় সাইরেন বাজিয়ে থানা প্রাঙ্গণ ত্যাগ করার বহু নজির অতীতে দেখেছে এদেশের মানুষ। কিন্তু এসব প্রথা ভেঙে নিপাট ভদ্র ব্যক্তিত্ব স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো.জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী নিজের কর্মের মাধ্যমেই দেখিয়ে দিলেন সাধারণ মানুষকে হৃদয়ঙ্গম করতে বেশি কিছু করার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই কথার তুবড়ি ছুটানোরও। শুধু দরকার হিমালয়সম একটি হৃদয় আর পরিচ্ছন্ন মন। দৃঢ় মনোবল, নিরলস পরিশ্রম, অধ্যাবসায় ও একাগ্রতা থাকলেই কাঙ্ক্ষিত বন্দরে নোঙর করা সম্ভব।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মতো চ্যালেঞ্জিং একটি দায়িত্ব পালনের শুরু থেকেই এখন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ পুলিশকে শুধু কাগজে কলমে নয়, জনসেবা ও কাজের মাধ্যমে বাস্তবিকভাবেই জনবান্ধব প্রমাণ করতে চেয়েছেন। আর এই উদ্যোগ সফলের জন্য আগে তিনি নিজে জনবান্ধব ভাবমূর্তির একের পর এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এরপর সর্বাগ্রে পুলিশ সদস্যদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করছেন। তাদেরকে উজ্জীবিত হয়ে ও জনসেবার মানসিকতা নিয়ে আরও বেশি উদ্যোগী হয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করছেন প্রতিনিয়ত-প্রতিক্ষণ। তিনি বিশ্বাস করেন, এমনটি সম্ভব হলেই পুলিশের হারানো গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার সম্ভব।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার শনিবারের (১৯ এপ্রিল) রুটিনে চোখ রাখলেই বাস্তবিক কিছু উদাহরণ মিলবে। রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করার লক্ষ্যে ধাপে ধাপে বিভিন্ন থানার কার্যক্রম পরিদর্শনের অংশ হিসেবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এদিন রাজধানীর বিমানবন্দর, উত্তরা পশ্চিম, তুরাগ ও উত্তরা পূর্ব থানায় গিয়েছিলেন। এর মধ্যে রাজধানীর তুরাগ থানা পরিদর্শনকালে তিনি থানাটিতে আসা সেবাপ্রার্থীদের খোঁজ খবর নিতে এগিয়ে যান। এ সময় এক প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

ভিডিওতে দেখা যায়, উপদেষ্টা থানায় উপস্থিত হয়ে এক বৃদ্ধ ব্যক্তির কাছে জানতে চান, ‘আপনার বিরুদ্ধে কে মামলা করেছে? উত্তরে ওই বৃদ্ধ ব্যক্তিটি বলেন, আমার স্ত্রী। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা তার কাছে জানতে চান, আপনি কয়টি বিয়ে করেছেন? তখন ওই ব্যক্তি বলেন চারটি। এই উত্তর শুনে উপদেষ্টাসহ অনেকেই বলেন, ‘মাশাআল্লাহ।’ ব্যস, উপস্থিত সবার মাঝে হাসির রোল পড়ে যায়।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ওই প্রবীণ ব্যক্তির কাছে আরো জানতে চান, তিনি (স্ত্রী) কিসের মামলা করেছেন? বৃদ্ধ লোকটি বলেন, নারী নির্যাতনের মামলা। পাশে থাকা একজন পুলিশ কর্মকর্তা তখন বলেন, এই বয়সে আবার বিয়ে করেছেন কেন? ওই বৃদ্ধ ব্যক্তি জানান, তার প্রথম দুই স্ত্রী মারা যান। এরপর যে নারীকে বিয়ে করেন, তার সঙ্গে ডিভোর্স হয়। পরে আবার বিয়ে করেন। এখন যিনি মামলা করেছেন, তিনি আগের সেই স্ত্রী এবং তার করা মামলা মিথ্যা বলে দাবি করেন তিনি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি দেখে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন।

স্ত্রীর মামলা খেয়ে থানায় এসে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মুখোমুখি সেই বৃদ্ধের আলাপচারিতার ভিডিও শেয়ার করে বুলবুল আহমেদ নামে একজন লিখেছেন- ‘এমন মানুষ অনেক দরকার। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে যত দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি।’ এমডি সোহেল রানার মন্তব্য-এরকম মন্ত্রীই বাংলাদেশে দরকার। মহিউদ্দিন নামে একজন লিখেছেন-সত্যিই অত্যন্ত ভালো মানুষ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। জহিরুল ইসলাম নামে একজন লিখেন এমন-‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম দেখলাম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা থানায় থানায় ঘুরে পুলিশ ও সাধারণ মানুষের খোঁজ খবর নেয়। এজন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই।’

এই থানা পরিদর্শনের পর গণমাধ্যমের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, স্বাধীনতার পর এই প্রথমবারের মতো আমরা পুলিশ সদস্যদের সেহরি ও ইফতারের টাকার ব্যবস্থা করেছি। ওনাদের প্রীতিভোজ, টিএডিএ’র ব্যবস্থা করছি। টিএডিএ’র টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আনতে হয়। তাঁরা যেন দ্রুত এটি পায় আমরা সেই চেষ্টা করছি।’ তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ নির্দেশনার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমার এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য হলো পুলিশ সদস্যদের থাকা ও খাওয়ার অবস্থা নিজ চোখে দেখার। তাদের থাকা-খাওয়ার মানোন্নয়নের জন্য মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আমাকে নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা সেই মোতাবেক কাজ করে চলেছি।’

রাজধানীর বিমানবন্দর থানা পরিদর্শনের পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা উত্তরা পশ্চিম থানা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি পুলিশের বিভিন্ন সমস্যা অবলোকন করেন এবং সাধারণ মানুষের বিভিন্ন সমস্যার কথা শোনেন। এ সময় গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে।’ তিনি স্বীকার করেন, ‘১৮ কোটি মানুষের দেশে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ সহজ কাজ নয়।’

তিনি পুলিশের অধস্তন (নিচের স্তরের) ফোর্সের জন্য থাকা-খাওয়ার মানোন্নয়নসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুখবর দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, ‘পুলিশের নিচের স্তরের সদস্যদের থাকার পরিবেশ খুবই নাজুক।’ বিষয়টি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে তিনি বলেন, ‘থাকার ব্যবস্থার মান খুব খারাপ। কীভাবে এটা উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন।’

তিনি জানিয়েছেন, বিভিন্ন থানা ঘুরে দেখা হচ্ছে, যাতে বাস্তব চিত্র অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া যায়। পুলিশ সদস্যদের খাবার ব্যবস্থাও ভালো করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেছেন যে, তাদের খাবারের গুণমান ও পুষ্টিমূল্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি যাতে পুলিশ সদস্যদের নিজ নিজ জেলায় রাখা যায়। এতে তারা পরিবারকে সময় দিতে পারবেন এবং মানসিক স্বস্তিও পাবেন। ছুটি কম থাকায় এটি আরও জরুরি হয়ে উঠেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এ সময় থানা থেকে বেরিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা থানার সেবাপ্রত্যাশীদের কাছে ছুটে যান। এ সময় এক বৃদ্ধা মা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে তাঁর গ্রেপ্তারকৃত সন্তানের বিষয়ে আকুতি জানান। এ সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘পুলিশ বিষয়টি দেখবে। সে নির্দোষ হলে তাকে ছেড়ে দিবে। কিন্তু দোষী হলে তাকে ছাড়া হবে না।’ এরপর উপদেষ্টা গাড়িতে উঠে গেলে আবারও সেখানে ছুটে যান ওই বৃদ্ধা নারী। উপদেষ্টা গাড়ির গ্লাস নামিয়ে পুনরায় ধৈর্য্যরে সঙ্গে তাঁর কথা শোনেন। উপদেষ্টা পুলিশ কর্মকর্তাকে ডেকে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেন।

সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এই ভিডিওটিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন নেটিজেনরা। শহীদুল্লাহ নামের একজন লিখেছেন-‘এমন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাই মানুষ চায়।’ আব্দুর রকিব নামের একজনের মন্তব্য- ‘ভাবতে অবাক লাগে নির্বাচনের পর এমন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে আমরা আর পাবো না।’ এমডি রিয়াদ হোসেন লিখেছেন- ‘আসলেই উনি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন।’ রিয়াদ উদ্দিন নামের আরেকজনের ভাষ্য-‘সমালোচনার সাথে সাথে নিজেকে বদলে নেওয়া বাংলাদেশের প্রথম কোন লোক দেখলাম।’

কালের আলো/এমএএএমকে