ঢাকার মন জয় করলেন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ
প্রকাশিতঃ 9:03 pm | September 11, 2023

কালের আলো রিপোর্ট:
তাঁর সফরের সময় ১৮ ঘন্টা। ঝটিকা এক সফর। ঠিক যেন এলেন, দেখলেন এবং ঢাকার মন জয় করলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। এই স্বল্প সময়ে কখনও ধানমন্ডি লেকের গাছপালার ভেতর দিয়ে হেঁটেছেন। জলের গানের শিল্পী রাহুল আনন্দের বাসায় কাটিয়েছেন আনন্দিত মুহুর্ত। প্রায় ১ ঘন্টা ৪০ মিনিট। রাহুলের স্টুডিওতে বসে শুনেছেন গান। জেনেছেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি প্রসঙ্গে। উপহার দিয়েছেন ও পেয়েছেন। আবার তুরাগ নদে নৌকায় ঘুরে বেড়ানো, সড়কের পাশে সিঙ্গারার দোকানে দাঁড়ানো সবই তার ব্যতিক্রমী বাংলাদেশ সফরের প্রমাণ।
সাধারণত কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে ভিভিআইপি নিরাপত্তার প্রটোকল থাকে। সাজসাজ রব থাকে চারিদিকে। ম্যাক্রোঁর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সফর ঘিরে কড়া নিরাপত্তা থাকলেও শক্তিধর এই দেশটির প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে ঢাকা দেখার আগ্রহ প্রকাশের কারণে অনেক কিছু যেন স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল। অল্প সময়ের সফরে তিনি মোটামুটি ঢাকা মাতিয়ে গেছেন।
ভারতে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলন শেষে রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) রাত ৮টার দিকে ঢাকায় পৌঁছালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দরে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে অভ্যর্থনা জানান। বিমানবন্দর থেকে সম্প্রতি চালু হওয়া ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আসেন ম্যাক্রোঁ। ফরাসি প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী হিসেবে ঢাকায় আসেন ফ্রান্সের ইউরোপ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী ক্যাথরিন কোলোনা।
প্রথাগতভাবে প্রটোকল অনুযায়ী ওই রাতে রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে অংশ নেন সফররত ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছোট বোন শেখ রেহানা, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ মন্ত্রিপরিষদের বেশ কয়েকজন সদস্য এসময় উপস্থিত ছিলেন। নৈশভোজের আগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন ম্যাক্রোঁ।

এরপর নিজের আগ্রহের জায়গা জলের গানখ্যাত শিল্পী রাহুল আনন্দের ধানমন্ডির বাসায় যান তখন রাত প্রায় ১২টা। সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও বাদ্যযন্ত্রী রাহুলের বাসায় প্রায় দুই ঘণ্টা কাটান তিনি। ওই সময়ে শিল্পীর গান শোনেন ম্যাক্রোঁ। রাহুল আনন্দ যে একতারা বাজিয়ে গান গেয়েছেন সেটি উপহার দেন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে। তিনি সেটি হাতে পেয়ে বাজানোর চেষ্টাও করেন। অবশ্য ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে রাহুল আনন্দও পেয়েছেন অন্যরকম উপহার। তাকে নিজে ব্যবহার করেন তেমন একটি কলম উপহার দিয়ে তা নিয়ে গান লেখার অনুরোধ করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট।
রাহুল আনন্দ বলেছেন, ‘ফরাসি প্রেসিডেন্ট গানের মানুষ। সংগীতই আমাদের দুই ভুবনের দুজন মানুষকে একসঙ্গে করেছেন। ম্যাক্রোঁ গিটারিস্ট। গান নিয়ে আমার যে জগত, সেটি দেখতে এসেছিলেন, আমি গর্ব অনুভব করেছি। তাকে বাংলাদেশের মাটির গান ও সুর শুনিয়েছি।’ ‘নাইয়া রে নাওয়ের বাদাম’, ‘আমি বাংলায় গান গাই’সহ কয়েকটি বাংলা গান ম্যাক্রোঁকে গেয়ে শোনান রাহুল। সেই সঙ্গে গানের মর্মবাণী ইংরেজিতে বুঝিয়ে দেন।
ফরাসি প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে কলম উপহার পেয়েছেন জানিয়ে রাহুল বলেন, ‘তিনি আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন, আমি যেন এই কলম দিয়ে গান ও কবিতা লিখি এবং লিখি প্রকৃতি ও প্রাণের কথা। একদিন উনি সেই গান শুনবেন।’

রাহুল আনন্দ জানান, কিছুদিন আগে ফরাসি দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে একটা আর্ট কোলাবরেশন হয়েছিল। সেখানে একজন মিউজিশিয়ান এসেছিলেন, নাম ম্যাক্স। তিনি ফরাসি, কিন্তু এখন বেলজিয়ামে থাকেন। রাহুল এবং ম্যাক্স দুজন মিলে কোলাবরেশন করেন।
রাহুল বলেন, আমি অনেক বাদ্যযন্ত্র বানিয়েছিলাম সাইকেলের নানা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে। সেখানে আমি ওগুলো বাজাই। ওটা কোনোভাবে প্রেসিডেন্টকে আকৃষ্ট করে। তারপরে তিনি আমার ব্যাপারে খোঁজ নেন। আমি নিজেই বাদ্যযন্ত্র বানাই এবং সেই বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মঞ্চে গান করি—এগুরো জেনে হয়তোবা তিনি কৌতূহলী হয়েছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট যে তার বাড়িতে কিংবা স্টুডিওতে আসতে চাইবেন, তা ধারণাও করতে পারেননি বলে জানান রাহুল।
সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকালে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গেলে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে হেঁটেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে তাকে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা ও তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি জাতির পিতার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি ঘুরিয়ে দেখান। এসময় তারা পঁচাত্তরে ১৫ আগস্টের কালরাতে ধানমন্ডির এই বাড়িতে ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনা বর্ণনা করেন ফরাসি প্রেসিডেন্টের কাছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পুরোটা ঘুরে দেখেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ইতিহাসসমৃদ্ধ নানা ছবি দেখেন তিনি। এরপর পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন।

পরিদর্শন বইতে ম্যাক্রোঁ লেখেন- বঙ্গবন্ধুর অবদান মনে রাখবে পুরো বিশ্ব। নিজ দেশের জন্যে এমন আত্মত্যাগের উদাহরণ পৃথিবীজুড়ে মানুষের জন্যে অন্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আর তার মাধ্যমেই তৈরি হয় ফ্রান্স বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত্তি। আর তাই এই ইতিহাস আর বন্ধুত্ব লালন করেন তিনি।
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন ম্যাক্রোঁ। পরে ঢাকা ত্যাগের আগে তুরাগ নদীতে নৌকা ভ্রমণ করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তুরাগ নদে ঘুরতে গেলে রাস্তার পাশের একজন বিক্রেতা তাকে শিঙাড়া-সমুচা-জিলাপি খাওয়ার অনুরোধ করেন। এসময় তাকে দোকান থেকে জিলাপি টিস্যুতে মুড়িয়ে হাতে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বিবেচনা করলে এই সফরটি অন্য যেকোনো ভিভিআইপি সফরের থেকে আলাদা। সাধারণভাবে যেকোনো ভিভিআইপি সফরে জাঁকজমক পর্ব বেশি থাকে। কিন্তু এবারে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন, যা অন্যদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায় না। সংক্ষিপ্ত সফর শেষে তিনি সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) দুপুর পৌনে তিনটার দিকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে একটি বিশেষ ফ্লাইটে প্যারিসের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। বিমানবন্দরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে বিদায় জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।

কালের আলো/ডিএস/এমএম