সংসদে মির্জা আজমের ৩৩ বছর
প্রকাশিতঃ 12:23 pm | February 27, 2023

মোহাম্মদ জাকিরুল ইসলাম:
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে মাত্র ২৭ বছর বয়সে সংসদ সদস্য (এমপি) হন মির্জা আজম। তিনি জাতীয় সংসদের জামালপুর-৩ (মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ) আসন থেকে সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে জনপ্রতিনিধিত্বের ৩২ পূর্ণ করে ৩৩ বছরে পদার্পন করছেন জননন্দিত এই নেতা।
অল্প বয়সে বড় দায়িত্ব নিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। জনকল্যাণে কাজ করতে গিয়ে প্রতিপক্ষ তৎকালীন সরকারি দলের নেতাদের রোষানলে পড়তে হয়েছে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন জামালপুরের তৎকালীন সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি জামালপুর-৪ সরিষাবাড়ি আসনের এমপি, বিএনপির মহাসচিব ব্যারিস্টার আব্দুল সালাম তালুকদারের সঙ্গে। জীবন বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছে বারংবার, তবু দমে যাননি। সাহস রেখে দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়ে গেছেন ভবিষ্যতের পানে। কঠিন সেই দুঃসময়ে মির্জা আজম ছিলেন অবিচল। সর্বকনিষ্ঠ এই সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদে বিএনপির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেন। সেই ঘটনায় তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টাসহ নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। তিনি পিছু হটেননি। বরং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জ্বীবিত মির্জা আজম এমপি বাংলার মানুষের কাছে উপনীত হয়েছেন সাহসী ও আপসহীন নেতা হিসেবে। বিরোধী দলে থাকার কারণে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এলাকার উন্নয়ন করার মতো সুযোগ তার ছিল না। তাই বলে তিনি নিশ্চুপ থাকেননি। সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নসহ বেশ কিছু কাজ করেন।
১৯৯৪ সালে দানবীর ও নারী শিক্ষার অগ্রদূত পিতা মির্জা আবুল কাশেম প্রতিষ্ঠা করেন নুরুন্নাহার মির্জা আবুল কাশেম মহিলা ডিগ্রি কলেজ, যার সার্বিক দেখভাল করেন মির্জা আজম। তৎকালীন সময়ে এ কলেজটি পাল্টে দিয়েছিল ওই অঞ্চলের নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের চিত্র। পরবর্তীতে তিনিও পিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে থাকেন।
তাঁর ৪৬ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে ৩২ বছর ধরে জাতীয় সংসদে জামালপুর- ৩ আসনের প্রতিনিধিত্ব করে চলেছেন। এই সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন বিরোধী দলীয় হুইপ, সরকার দলীয় হুইপ এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে। সফল ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আমুল পরিবর্তন করেছেন ‘ভেস্তে’ যাওয়া পাট খাত।
একাদশ জাতীয় সংসদে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান। বর্তমানে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে ঢাকা বিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন। মির্জা আজম এমপি যেখানে যে দায়িত্ব পেয়েছেন সেখানেই সফলতার পরিচয় দিয়েছেন।
একসময়ের অবহেলিত ও অনুন্নত জেলা জামালপুরকে সমৃদ্ধ জনপদে রূপান্তর করে তিনি প্রমাণ করেছেন একজন রাজনৈতিক নেতার সততা, নিষ্ঠা, মেধা, সক্ষমতা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে নিজের নির্বাচনী এলাকাসহ সমস্ত জেলার উন্নয়ন করা সম্ভব। তিনি তার নির্বাচনী এলাকার জনগণকে মনিব মনে করেন। নেতৃত্বের গুণে গুণান্বিত জনপ্রতিনিধি মির্জা আজম এমপি হালআমলে বাংলাদেশের নেতৃত্বের রোল মডেল।
তিনি কথার চেয়ে কাজে বেশি বিশ্বাসী, দিনরাত এক করে পরিশ্রম করেন। দায়িত্ব ও সংকট মোকাবেলায় দেশরত্ন শেখ হাসিনার নির্দেশ পালনে আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত প্রাণ।
তিনি বলেন, ‘‘১৯৯১ সালে অত্যন্ত তরুণ বয়সে যখন আমি প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হই, তখন নেত্রী আমাকে একটি মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি (শেখ হাসিনা) বলেছিলেন- ‘তুমি যদি তোমার এলাকার মানুষকে প্রভূ হিসেবে মানতে পারো এবং নিজেকে তাদের চাকর মনে করে সেবা করতে পারো আর সৎভাবে জীবনযাপন করো তাহলে সারাজীবন তুমি এমপি হতে পারবে।’ সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর সেই কথাটি মেনে চলেছি বলেই ছয়বার এমপি হয়েছি , প্রতিবার শুধু ভোটের পার্থক্যই বেড়েছে, ভোটের পরিমাণই বেড়েছে৷ অতএব শেখ হাসিনার নির্দেশিত পথে চললে কেউ কোনোদিন পরাজিত হবে না।’’
জামালপুরের ২৬ লক্ষ মানুষ মির্জা আজমের নেতৃত্বের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থাশীল। তাঁর নেতৃত্বে জেলায় প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলমান। মানুষ যা চেয়েছে তাই পেয়েছে এবং চাওয়ার বাইরেও তার উন্নয়ন ভাবনা থেকে অনেক কাজ করেছেন। পিছিয়ে থাকা প্রাণের জামালপুরকে আজ উন্নত, আধুনিক জেলা হিসেবে বাংলাদেশে পরিচিত করিয়েছেন। সেই জন্য তাঁকে আধুনিক জামালপুরের জনক বা রূপকারও বলা হয়।
এদিকে শিক্ষা বিস্তারে জননেতা মির্জা আজমের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করেন, টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। তাই জেলার অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত ৪৩টি নতুন স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সাধারণ মানুষ ভালোবেসে তাকে ‘শিক্ষাবন্ধু’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। কোন নেতৃত্ব প্রধান ব্যক্তির নিকট থেকে এ ধরনের শিক্ষাবিষয়ক উন্নয়ন সত্যিই বিরল। তার প্রতিষ্ঠিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত অর্ধশতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ২০২১ সাল অবধি পাঠ গ্রহণ করেছেন ২২,৭২৫ জন শিক্ষার্থী।
এছাড়া বিভিন্ন স্তরে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বের হয়ে গেছে ৫০ হাজার ৫০১ শিক্ষার্থী। যারা বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত।
এছাড়া তার নির্বাচনী এলাকা মেলান্দহ উপজেলায় পুরোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৮৬টি। তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আরও ৭৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। প্রায় প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পেছনে মির্জা আজম এমপির ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি এই ৭৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে জমি দান করেন, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে নগদ অর্থ প্রদান করেন। ৭৪টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি বিদ্যালয় জাতীয়করণ করার ক্ষেত্রে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে নিবিড় যোগাযোগ, আন্তরিক সহযোগিতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। ৭৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট শিক্ষক সংখ্যা ৩৭০ জন। কর্মচারীর সংখ্যা ৭৪ জন। শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি মেলান্দহ উপজেলায় ৪৪৪ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে।
এছারা মাদারগঞ্জ উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বর্তমানে ১৯৯টি। পুরোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ৬৬টি এবং নতুন করে আরও ১শ ৩৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন তিনি। প্রথম ধাপে ৯৩, দ্বিতীয় ধাপে ২৬ ও তৃতীয় ধাপে ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ মোট ১৩৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয় অত্র উপজেলায়। এই ১শ ৩৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনেও জমি দান, নগদ অর্থ প্রদানসহ প্রত্যেকটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করার ক্ষেত্রে মির্জা আজম এমপি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তিন ধাপে ১৩৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করায় অত্র উপজেলায় শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি ৬৬৫ জন শিক্ষক ও ১৩৩ জন কর্মচারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
মেলান্দহ ও মাদারগঞ্জ উপজেলায় মির্জা আজম এমপির প্রচেষ্টায় মোট ২০৭টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়। তার প্রতিষ্ঠিত এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ১০৩৫ জন শিক্ষক ও ২০৭ জনকর্মচারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মোট শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা ১২৪২ জন। এছাড়া দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং তাঁর আন্তরিক সহযোগিতায় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বহুতল একাডেমিক ভবন নির্মিত হয়েছে।
এদিকে মির্জা আজম এমপি প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবরেণ্য স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের নামানুসারে নামকরণের মাধ্যমে এক অনন্য দৃষ্টান্ত ও ভালোবাসার বিরল নজির স্থাপন করেছেন।
বাংলাদেশ নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা নিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। মির্জা আজম এমপি টানা ষষ্ঠ বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে অগ্রণী ভূমিকায় জামালপুরকে জাতীয়ভাবে যুক্ত করতে সর্বাগ্রে তৎপর রয়েছেন।
বিশেষ করে জামালপুরে স্থাপিত বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে তার প্রমাণ মেলে। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সজীব ওয়াজেদ জয় হাইটেক পার্ক, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, টেক্সটাইল কলেজ, শেখ রাসেল টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, শেখ হাসিনা নকশি পল্লী, মেডিকেল টেকনোলজি,নার্সিং ইনস্টিটিউট, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ফ্যাশন ডিজাইন ইনস্টিটিউট, পল্লী উন্নয়ন একাডেমির মতো অর্ধশতাধিক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও। যে কারণে এক সময়ের অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ জামালপুর এখন সমৃদ্ধ জামালপুরে রূপান্তরিত হয়েছে।
জানা যায়, মির্জা আজম এমপির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নির্মাণের জন্য নিজে জমি দান করেছেন ১৫০ একর, যার বর্তমান বাজার মূল্য ৫০০ কোটি টাকারও অধিক। মির্জা আজম নিজ দূরদর্শী চিন্তায় প্রমাণ করেছেন একজন রাজনৈতিক নেতা তথা
জনপ্রতিনিধির মেধা, সততা, সদিচ্ছা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে নিজের নির্বাচনী এলাকা-সহ সমস্ত জেলার উন্নয়ন করা সম্ভব।
এদিক দিয়ে বিশ্লেষণ করলে তার ৪৬ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ও ৩২ বছরের সংসদ সদস্যের জীবন নিঃসন্দেহে তরুণ রাজনীতিবিদদের জন্য দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে তরুণ রাজনীতিকদের কাছে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন মির্জা আজম। যারা তার পথ ধরেই দেশকে এগিয়ে নেবেন সমৃদ্ধির পথে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত এই ত্যাগী শিক্ষাপ্রেমী জননেতা ও জামালপুরের প্রিয়মুখ প্রাণের মানুষ মির্জা আজম সংসদ সদস্য হিসেবে টানা ৩২ বছর থেকে ৩৩ বছরে পদার্পণ করছেন— গৌরান্বিত এই ক্ষণে প্রিয় নেতার প্রতি রইলো অভিনন্দন ও রক্তিম গোলাপের সংগ্রামী শুভেচ্ছা।
লেখক: লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী।