যেভাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিতঃ 10:31 am | March 04, 2022

আকবর আলি খান:

আকবর আলি খানের ‘পুরনো সেই দিনের কথা’ শীর্ষক গ্রন্থে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠনের তথ্য উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু যেভাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থের ৩৩৮ পৃষ্ঠায় সেই সম্পর্কে লিখেছেন আকবর আলি খান। পাঠকের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো।

ইউসুফ আলী বঙ্গভবন থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এসে আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি বিলেন যে বঙ্গবন্ধু তাকে ঢাকায় ইসলামি একাডেমি চালু করার জন্য আদেশ দিয়েছেন। পাকিস্তানে ইসলামি একাডেমি প্রথম চালু করেছিলেন আইয়্যুব খান। ইসলামি একাডেমির পরিচালক ছিলেন আবুল হাশিম। পাকিস্তান ছিল একটি ধর্মরাষ্ট্র, যার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান। ইসলামি ধর্মরাষ্ট্রে ইসলামি একাডেমি করাতে কোনো অসুবিধা নেই; কিন্তু একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ইসলামি একাডেমি চালু করা হলে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা সম্মন্ধে প্রশ্ন উঠতে পারে। আমি ইউসুফ আলীকে বললাম, ‘আপনি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে। সেই রাষ্ট্রে ইসলামি একাডেমি করা কি যুক্তিসংগত হবে?’ আমি ইউসুফ আলীকে এ সম্পর্কে মানণীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি নোট পাঠাতে অনুরোধ করি। ইউসুফ আলী চিন্তা করে বলেন, ‘আপনি আপনার বক্তব্য লিখিতভাবে দেন। আমি তা মানণীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করবো’। আমি উৎসাহিত হয়ে এ সম্পর্কে বইপত্র জোগাড় করে নোট লিখতে শুরু করি। রাতে বাসায় গেলে নোট লিখতাম। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে প্রায় ৫০ পৃষ্ঠার একটি হস্তলিখিত নোট তৈরি করি, যা টাইপ করলে হয়তো ২০ পৃষ্ঠার মতো হতো। আমি আমার নোটে ইসলামি একাডেমি পুনরায় স্থাপন করলে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির সঙ্গে তা যে সাংঘর্ষিক হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বক্তব্য লিখি। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সম্পর্কেও বক্তব্য উপস্থাপন করি। সবশেষে আমি যুক্তি দেখাই ইসলামি একাডেমি স্থাপন করলে তা রাষ্ট্রের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এর কারণ হলো ধর্মের প্রতিটি প্রশ্নেই মতবিরোধ রয়েছে। যদি ইসলামি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে প্রতিটি বিতর্কিত প্রশ্নে ইসলামি একাডেমির বক্তব্য রাষ্ট্রের জন্য চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। ধর্মের বিষয়ে সব ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছা সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে আমি লাহোরের কাদিয়ানি দাঙ্গা সম্পর্কে বিচারপতি মুনির কমিশনের তদন্ত রিপোর্টের উল্লেখ করি। বিচারপতি মুনির ইসলামের সংজ্ঞা সম্পর্কে ১৪০ জন আলেমকে প্রশ্ন করেছিলেন। ১৪০ জন আলেম ১৪০ ধরনের জবাব দিয়েছেন। কেউ কারো সঙ্গে একমত হননি। সুতরাং ইসলামি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করলে রাষ্ট্রের জন্য সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। আমি নথি দাখিল করলে শিক্ষাসচিব এবং শিক্ষামন্ত্রী কোনো কিছু না লিখে শুধু স্বাক্ষর করে মানণীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠান। এই ফাইল যাওয়ার পর প্রায় মাস তিনেক এ সম্মন্ধে আমরা আর কোনো সারাশব্দ পাইনি। তিন মাস পর আমার বিরাট নোটের নিচে বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা ছোট একটি নির্দেশ পেলাম। তিনি লিখেছেন, ‘ইসলামি একাডেমি সম্বন্ধে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা পড়লাম। আলোচককে ধন্যবাদ। তবে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি হলো এখানে ইসলামি একাডেমির প্রয়োজন রয়েছে। তাই ইসলামি একাডেমি স্থাপণের জন্য ত্বরিত ব্যবস্থা নিন’। আমার মনে হয় এ ঘটনাটি প্রধানন্ত্রীর অফিসের ও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এ ঘটনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব মশিউর রহমান লিখেছেন:

ইসলামিক ফাউন্ডেশন সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হতে একটি নথি পাওয়া গেল। চল্লিশ-পঞ্চাশ পৃষ্ঠা দীর্ঘ নোটের মূল বক্তব্য অসাম্প্রদায়িক দেশে ধর্মবিষয়ক এরূপ প্রতিষ্ঠান যুক্তিহীন, অসাম্প্রদায়িক তত্ত্বের সাথে সংগতিহীন। বঙ্গবন্ধুর কাছে নথি উপস্থাপণ করলে নথিটি রেখে দিতে বলেন। মানণীয় শিক্ষামন্ত্রী কয়েকবার তাগাদা দেন। এক-দেড় মাস পর বঙ্গবন্ধু নিম্নোক্ত মর্মে সিদ্ধান্ত দিলেন, ‘এ দেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দরকার আছে, থাকবে’। আমাদের বোঝালেন, সাধারণ মোল্লা- মৌলভিদের আরবি ভাষা ও ধর্মশাস্ত্র জ্ঞানের ঘাটতি আছে, কিন্তু তাদের প্রভাব ব্যাপক। ধর্মান্ধতা দূর করতে ও ধর্ম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান বিস্তারে ফাউন্ডেশনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্যই গভীর ধর্মশাস্ত্র জ্ঞান প্রয়োজন।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা হতে পারে কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে তার সিদ্ধান্ত যে নির্ভুল, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। বঙ্গবন্ধু শুধু ইসলামি একাডেমি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন; কিন্তু তার পরবর্তী শাসকেরা শাসনতন্তে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিয়েছে। এই বিধান সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ বেশি সদস্যের অনুমোদন নিয়ে এখনো চালু রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ শুধু সাম্প্রদায়িকতার অনুপস্থিতি। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে অধিকাংশ মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেনি।

লেখক: বাংলাদেশী সরকারী আমলা, অর্থনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদ