বিজয়ের ৫০ বছরে বিজিবি, বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট অর্জনে অহর্নিশ পথচলা

প্রকাশিতঃ 5:24 am | December 18, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

১৭৯৫ সালে রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন নামে গড়ে উঠা বাহিনীটির যাত্রা শুরু। গোড়াপত্তনের সেই সময়ে সাকুল্যে সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৪৮ জন। কালের বিবর্তনে এটি এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। আগামী ৫ বছরে বাহিনীটিতে নিয়োগ দেওয়া হবে আরও ১৫ হাজার সদস্য।

স্বাধীনতা যুদ্ধে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখা এই বাহিনীটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে রোজকার সময় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। বীরত্ব আর শৃঙ্খলার প্রতীক আধা-সামরিক এই বাহিনী বিজয়ের ৫০ বছরে আধুনিক ও যুগোপযোগী এক বাহিনী হিসেবে দেশের পরিমন্ডল ছাপিয়ে বৈশ্বিক পরিমন্ডলেও নিজেদের মেলে ধরেছে।

মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের স্বাক্ষর রাখা বিজিবিকে নিয়ে আরও বিশাল এক স্বপ্ন বুনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘সীমান্ত রক্ষায় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বিজিবি’- ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর পিলখানায় বিজিবি দিবসে এমন আশাবাদী উচ্চারণই করেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।

সরকারপ্রধানের প্রত্যাশা পূরণে তারই দূরদর্শীতায় বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলামের সুদৃঢ় নেতৃত্বে দেশের জলে, স্থলে ও আকাশপথের সুরক্ষা নিশ্চিত করে ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে রূপ নিয়েছে বিজিবি।

কেবল সীমান্ত রক্ষাই নয়, অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং প্রাকৃতিক অথবা সামাজিক যেকোন দুর্যোগে দেশের মানুষের আস্থার ঠিকানায় পরিণত হয়েছে গৌরবোজ্জ্বল এই বাহিনীটি। এই বাহিনীর সদস্যদের অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে বাড়ানো হচ্ছে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও।

দু’দিনব্যাপী বিজিবি দিবস, প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী
আগামী ১৯ ও ২০ ডিসেম্বর দু’দিনব্যাপী বিজিবি দিবস পালন করা হবে। এখন চলছে শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি।

বিজিবি সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, দিবসের কর্মসূচি অনুযায়ী ১৯ ডিসেম্বর রাজধানী পিলখানাস্থ বিজিবি সদর দপ্তরের বীর উত্তম আনোয়ার হোসেন প্যারেড গ্রাউন্ডে সকাল ১০টায় বিজিবি দিবসের আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ শুরু হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করবেন।

পরে সকাল ১১টায় প্রধান অতিথি হিসেবে গণভবন থেকে ভিডিও টেলিকনফারেন্সের (ভিটিসি) মাধ্যমে সরাসরি সংযুক্ত হয়ে অভিবাদন গ্রহণ এবং ভাষণ প্রদান করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি পিলখানায় নবনির্মিত ‘সীমান্ত সম্মেলন কেন্দ্র’ এর শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করবেন।

এই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিজিবি’তে বীরত্বপূর্ণ ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বিজিবির কর্মকর্তা ও সদস্যদের পদক প্রদান করবেন। এছাড়া মোটর শোভাযাত্রা এবং ‘স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব শতবর্ষ উদযাপন’ উপলক্ষে সম্মিলিত প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে।

বিজিবি দিবসের অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন এবং আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মহাপরিচালক পংকজ কুমার সিং সহ ৭ সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধি দল উপস্থিত থাকবেন।

এছাড়া ‘বিজিবি দিবস-২০২১’ উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে বিরাজমান পারস্পারিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ও আস্থা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আগামী ২০ ডিসেম্বর বিকেলে যশোরের বেনাপোল-পেট্রাপোল, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া-আগরতলা স্থলবন্দর সংলগ্ন আইসিপিতে বিজিবি-বিএসএফ কর্তৃক জমকালো ‘জয়েন্ট রিট্রিট সিরিমনি’ অনুষ্ঠিত হবে।

৫০ বছরের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগ্রযাত্রায় বিজিবি
চলতি বছরের বিজিবি দিবস উপলক্ষে তৈরি করা হয়েছে দু’মিনিটের একটি ভিডিও ডকুমেন্ট্রি। যেখানে উঠে এসেছে গত ৫০ বছরে বিজিবির অপ্রতিরোধ্য ও দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলার বাস্তব চিত্র।

ভিডিও স্টোরিটির শুরুতেই ‘অনুপ্রেরণা’ শব্দটির সঙ্গে মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণের ছবি দেয়াল চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। যে ভাষণ ছিল সংগ্রাম ও মুক্তিকামী মানুষের অভূতপূর্ব উদ্দীপনার স্মারক।

পাকিদের বিরুদ্ধে বাঙালির নিরন্তর লড়াই সংগ্রাম, সামরিক জান্তার বর্বর উপাখ্যান সেই দেয়ালজুড়ে। ছবির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের স্বাধীনতার ঘোষণা ও শেষবারের মতোন ভুট্টো-ইয়াহিয়াদের সতর্ক করার বজ্রনির্ঘোষ উচ্চারণ- ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমাদের লোকেদের হত্যা করা হয়। তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’ প্রচার করা হয়।

ধন্য সেই পুরুষের অমর-অব্যয় সেই কন্ঠের ফাঁকেই বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফের ছবি ও বায়োগ্রাফি দেখানো হয় পর্দায়।

ভাষ্যকারের কন্ঠ প্রথমবার- ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় উত্তরাধিকার’ উচ্চারণের ফাঁকে বিজিবি সদর দপ্তরের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর স্বাধীনতা স্তম্ভকে
অনিন্দ্যসুন্দরভাবেই তুলে আনা হয়।

পর্দায় এরপর দেখানো হচ্ছে সুশৃঙ্খল বিজিবির বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজের চিত্র। কুচকাওয়াজ পরিচালনাকারীর কন্ঠে কমান্ড ‘সাবধান হবে…..।’

৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পিলখানায় ৩য় ব্যাচের সমাপনী কুচকাওয়াজে বলেছিলেন, ‘আমি যখন প্রথম পিলখানায় আসি, জেল থেকে বের হওয়ার পরে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। আমি দেখেছিলাম কিছুই নাই। তারা (পাকিস্তানি হানাদার) প্রায় সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।’ জাতির পিতার নিজ কন্ঠের সেই বক্তব্য দেখানো হলো এভাবেই।

এরপরই মুজিববর্ষের প্যানাফ্ল্যাক্স ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর লোগো ভেসে উঠলো। দেখানো হলো বিজিবি সদর দপ্তর, যেটি ধারণ করা হয়েছে চলতি বছরের ডিসেম্বরে।

তখন ভাষ্যকারের কন্ঠে- ফিনিক্স পাখির মতো পুনরুত্থান’ বাক্যের সঙ্গে দেখানো হচ্ছে আকাশে উড়ন্ত ত্রিমাত্রিক বাহিনী বিজিবির কপ্টার। ছুটে যাচ্ছে দুর্গমে।

‘বর্ডার গার্ড ভিশন ২০৪১’ মোটা দাগে লেখাটি ফোকাসের মাধ্যমে বিজিবির ঘুরে দাঁড়ানো, আধুনিক ও উন্নত বিজিবির পথচলার চিত্রপট অঙ্কনের মতোই বাহিনীটিকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশাবাদী এক উচ্চারণ উঠিয়ে আনা হলো।

এই ভিশনের আলোকে বিজিবির কমান্ড স্তর বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি কলেবর বাড়ানো, সীমান্তে পাকা সড়ক তৈরি, নারী সৈনিক নিয়োগ, স্মার্ট ডিজিটাল বর্ডার গার্ড সার্ভিলেন্স অ্যান্ড ট্যাকটিক্যাল বর্ডার রেসপন্স সিস্টেমের সাহায্যে আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমন, অল টেরেইন ভেহিকল (এটিভি), আর্মার্ড পার্সোন্যাল ক্যারিয়ার (এপিসি), রায়ট কন্ট্রোল ভেইকেল (আরভি), হাই স্পিড বোট (সিলভার ক্র্যাফট, হারিকেন সান ওয়েপন ১৮৭) এবং অত্যাধুনিক অ্যান্টি ট্যাংক গাইডেড ওয়েপনও সংযুক্ত করা হয়েছে। রাশিয়া থেকে কেনা হয়েছে দুটি এমআই-১৭১ হেলিকপ্টার।

ভিডিও স্টোরিটি থেকে আরও দেখা গেছে, পিলখানায় ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বিজিবি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মর্যাদা অর্জন করবে। সেই বিশ্বাস আমার আছে।’ পেছনেই সেই সময় দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা প্রতিপালনে বিশ্বস্ততা ও যোগ্যতার পরিচয় দেওয়া বাহিনীটির মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম।

১৭৯৫ থেকে ২০২১ দায়িত্ব পালনে ২২৬ বছর সময় পাড়ি দিয়েছে রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন থেকে হালের বিজিবি। ১৭৯৫, ১৮৬১, ১৮৯১, ১৯২০, ১৯৪৭, ১৯৭২, ১৯৯৭ ও ২০১০ সময়ে সময়ে নতুন পোশাকে এই বাহিনীর সদস্যদের অবস্থান চিত্রিত হয়েছে।

ডকুমেন্ট্রিতে ভাষ্যকার যেন বলে চলেছেন, ঐতিহ্যবাহী বাহিনীর আধুনিকায়ন, জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে চলা এবং প্রতিরক্ষার প্রথম বেস্টনী ত্রিমাত্রিক বিজিবি।

দু’ মিনিটের এই ভিডিও ডকুমেন্ট্রিতে ১ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের সময়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে বিজিবির কপ্টারের দিকে ডিজি মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলামের এগিয়ে যাওয়া প্রকারান্তরে অক্লান্ত পরিশ্রমে তার নানামুখী কর্মযজ্ঞের প্রতীকী এক উপস্থাপনা।

দেশের নানা প্রান্তে চষে বেড়িয়ে নিজ বাহিনীর সদস্যদের প্রায় সময়েই উজ্জীবিত-উদ্দীপ্ত করে থাকেন এই ডিজি। অভিভাবকত্বের ছায়ায় আগলে রাখেন সবাইকে। সেই উপস্থাপনাও এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে।

ভাষ্যকার বলছেন, সীমান্ত রক্ষায় নিবেদিত প্রাণ, একদল সৈনিকের দেশপ্রেম, পেশাদারিত্ব, শৃঙ্খলা, আত্নত্যাগে পৃথিবীর বুকে দৃশ্যমান একটি মানচিত্র, নিরাপদ বাংলাদেশ।

এখানে সীমান্ত রক্ষায় বিজিবির অ্যাকশন, নরম গরম কৌশল, সব বাঁধা পেরিয়ে দুর্গম এলাকায় অহর্নিশ ছুটে চলা দুরন্ত, দুর্বার গতিতেই চিত্রিত হয়েছে। শেষে উচ্চারণ করা হয়েছে- ‘ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী’।

কালের আলো/এমএএএমকে

Print Friendly, PDF & Email