আশা-আকাঙ্খার সংলাপ আজ

প্রকাশিতঃ 11:46 am | November 01, 2018

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের রাজনীতিতে চলেছে বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ আর নানা সমীকরণ। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংলাপের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। যা ‘টক অব দা কান্ট্রি’তে পরিণত হয়েছে। সেই বহুল প্রতীক্ষিত সংলাপ আজ। গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের ১৬ সদস্যের দলের নেতৃত্বে থাকছেন ড. কামাল হোসেন। আর আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দেবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশজুড়ে শুধু সংলাপ নয় এর পাশাপাশি আলোচনা হচ্ছে এখন এর ফলাফল নিয়েও। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা রাজনীতির ‘বরফ’ সংলাপের মাধ্যমে কী গলবে, না-কি জট আরও বাঁধবে? আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে কী হতে পারে আগামীর নির্বাচনে- এমন প্রশ্নও এখন জনমনে। সব মিলিয়ে সবার নজর এখন গণভবনে।

সংলাপ প্রসঙ্গ রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সংলাপ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার আপাতত কোনো কারণ নেই। কারণ, আমরা আগেও এমন সংলাপ দেখেছি। অর্থবহ আলোচনা হয়েছে- এমন নজির আছে বলে আমার জানা নেই। এমনকি গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও সংলাপের আলোচনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়।

এই বিশ্লেষক বলেন, সংলাপ ফলপ্রসূ হবে কি-না তা নির্ভর করবে অংশগ্রহণকরীদের আন্তরিকতার ওপর। যেসব এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তার অনেক কিছুই সাংবিধানিক। সংবিধান পরিবর্তনের ব্যাপার আছে। আবার অনেক বিষয় আছে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে জড়িত।

‘হঠাৎ সংলাপ প্রসঙ্গে সরকারের ইউটার্ন’- এমন বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আরও অপেক্ষা করতে হবে। কী হবে, তা আলোচনা থেকেই বেরিয়ে আসবে। বৈশ্বিক রাজনীতি পরিবর্তন হয়েছে। সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশে নির্বাচন হয়েছে, তেমন প্রশ্ন ওঠেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে বিশ্বমহলে প্রশ্ন আছে। ধারণা করা যেতেই পারে, সরকার সংলাপের জন্য আন্তর্জাতিক মহল থেকেও অবগত হচ্ছেন।

তবে সংলাপের ব্যাপারে আশাবাদী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, জনগণ ক্ষমতার মালিক। কিন্তু রাজনীতির মধ্য দিয়েই জনগণকে ক্ষমতাবঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। আমরা জনগণের রাষ্ট্র জনগণকে ফিরিয়ে দিতে আন্দোলন করছি। এ আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংলাপের ফলাফল প্রসঙ্গে বলেন, আমরা আমাদের দাবি আর লক্ষ্য ঘোষণা করেছি। সময় বদলে গেছে। মানুষ এখন হিংসার রাজনীতি করতে চায় না। এই উপলব্ধি থেকে ক্ষমতাসীন দল সংলাপে ইতিবাচক সাড়া দেবে বলে আমি মনে করি।

একই প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাজনীতির নামে রাষ্ট্র, সমাজে যে দুঃশাসন চলছে, তা থেকে মুক্তি পেতে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। সংলাপ সময়ের দাবি। আমরা দীর্ঘদিন থেকেই সংলাপের দাবি জানিয়ে আসছি। মানুষের মুক্তির জন্য জাতীয় ঐক্যের কথা আমরাও বলে আসছি। সরকার কর্ণপাত করেনি। ১ নভেম্বর কী আলোচনা হয়, তা দেখার অপেক্ষা।

সংলাপের ফলাফল প্রসঙ্গে সেলিম বলেন, রুটি ভাগাভাগির জন্যও সংলাপ হতে পারে। আমরা ইতোপূর্বে বহু সংলাপ, আলোচনা দেখেছি। তাতে গণমানুষের লাভ হয়নি। বরং বৈষম্য বেড়েছে। সংলাপের স্বার্থকতা নির্ভর করে মূলত ক্ষমতাসীনদের আন্তরিকতার ওপর। সরকার চাইলে একদিনের মধ্যেই চলমান সংকট নিরসন করতে পারে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, একদিন আগেও কেউ এটা ভাবেননি। আগে আমিও বলেছি সংলাপ হবে না। সেটা ছিল আমার রাজনৈতিক কৌশল। এখন সংলাপ হচ্ছে। এখন দেখা যাক সংলাপে ‘সংকটের বরফ’ গলে কি-না! যদিও আমরা সংকট দেখছি না। সংকট তাদের (বিএনপি)। তাদের ভাষায় সংকট।

তিনি আরও বলেন, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সরকারি দলের সংলাপে খোলামেলা আলোচনা হবে। ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবি ও ১১ লক্ষ্য আলোচনার টেবিলে তোলা হবে। আলোচনার টেবিলেই সিদ্ধান্ত হবে। ঐক্যফ্রন্টের কিছু দাবি সংবিধান সম্মত নয়, সে ক্ষেত্রে কী হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তারা (ঐক্যফ্রন্ট) তাদের দাবিতে অটল থাকবে, না সরে আসবে; দেখেন না কী হয়!’

যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট সংলাপের আয়োজনের বিষয়টি ‘ইতিবাচক অগ্রগতি’ এবং ‘অসাধারণ অর্জন’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। প্রায় চার বছর বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন শেষে মঙ্গলবার বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের বিষয়টি কোনো একজন রাজনৈতিক নেতা বা কোনো একটি দলের ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিৎ নয়। তিনি বলেন, সংলাপের বিষয়টি কেবল দলের উচ্চপর্যায়ের ভেতরে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয় নয়, বরং দলের সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ এবং সারাদেশে জনগণের কল্যাণে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়টি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে বিদায়ী সাক্ষাতে ‘বাংলাদেশের উন্নয়নে তার দেশ সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে’ বলেও জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী এ সময় বার্নিকাটের সর্বাঙ্গীণ সাফল্যও কামনা করেন।

কোনো বৈদেশিক চাপে সংলাপ হচ্ছে না। এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। মঙ্গলবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাঁদমারী এলাকায় জেলা রেজিস্ট্রার নবনির্মিত ভবনের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সংলাপের জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি দিয়েছেন। তার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে গণতন্ত্র অর্জিত হয়েছে। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার জন্য সংবিধানসম্মত যে কোনো আলোচনার ব্যাপারে তার দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত। এতেই বোঝা যায় কোনো বৈদেশিক চাপে সংলাপ হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আত্মমর্যাদাশীল একজন ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশকে তিনি একটি মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। তিনি কোনো বিদেশি চাপে নত হওয়ার মতো মানুষ নন। তারপরও আমি বলব, বিদেশি কোনো চাপ ছিল না। বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে চলছে। সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বাংলাদেশে এ সরকার কোনো কিছুই করেনি এবং সংবিধানের ধারাবাহিকতা সংবিধানসম্মত যে কাজ আমরা সেই কাজ করে যাবো।’

সংসদ ভেঙে, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একাদশ সংসদ নির্বাচনের দাবি তোলা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গত রোববার সংলাপের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনাকে চিঠি পাঠায়। পরদিনই সংলাপে রাজি হওয়ার কথা জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাদের।

মঙ্গলবার সকালে আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আবদুস সোবহান গোলাপ শেখ হাসিনার আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দেন কামাল হোসেনকে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে পাঠানো ওই চিঠিতে শেখ হাসিনা লেখেন, ‘অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সংবিধানসম্মত সকল বিষয়ে আলোচনার জন্য আমার দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত।’

আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র পাওয়ার পর বিকেলে বৈঠকে বসেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। বৈঠকের পর জেএসডি সভাপতি আ স ম আব্দুর রব নিজেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ‘মুখপাত্র’ পরিচয় দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করেছি। আমরা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় গণভবনে যাব। ঐক্যফ্রন্টের ১৫ নেতা যাবেন। কামাল হোসেন আমাদের নেতা, উনি ১৫ জনের বাইরে। তিনি আরও জানান, সংলাপে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে ৭ দফার ভিত্তিতে আলোচনা হবে। দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে আলোচনা হবে। সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যেন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে- এটা নিয়ে আলোচনা হবে। সংলাপে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২১ জন

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোটের ২১ নেতা অংশ নেবেন। বুধবার আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সোবাহান গোলাপ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ২১ নেতার মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৭ জন, জাসদের দুই নেতা, সাম্যবাদী দলের ১ জন ও ওয়াকার্স পার্টির ১ জন উপস্থিত থাকবেন।

সংলাপে আওয়ামী লীগের ১৭ নেতার মধ্যে রয়েছেন- প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, কাজী জাফরুল্লাহ, ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম, আওয়ামী লীগের স্থায়ী কমিটির সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক।

এছাড়াও আওয়ামী লীগের ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, রমেশ চন্দ্র সেন, মাহবুব উল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, আব্দুর রহমান, ড. আবদুস সোবাহান গোলাপ, ড. হাছান মাহমুদ ও অ্যাডভোকেট শ. ম. রেজাউল করিম বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন। অন্যদিকে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও মঈনুদ্দিন খান বাদল, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া এবং ওয়াকার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন বৈঠক অংশ নেবেন।

সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের যারা থাকছেন: গণভবনের সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের প্রতিনিধি দলের দলনেতা হিসেবে থাকবেন ড. কামাল হোসেন। বিএনপি থেকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ও মির্জা আব্বাস। নাগরিক ঐক্য থেকে থাকবেন মাহমুদুর রহমান মান্না ও এস এম আকরাম। গণফোরাম থেকে মোস্তফা মহসিন মন্টু ও সুব্রত চৌধুরী। জেএসডি থেকে আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল মালেক রতন ও তানিয়া রব। ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, আ ব ম মোস্তফা আমিন ও স্বতন্ত্র হিসেবে থাকবেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

কালের আলো/এনএম