করোনার নতুন ‘হটস্পট’ সীমান্তবর্তী গ্রাম

প্রকাশিতঃ 10:17 am | June 12, 2021

জ্যেষ্ঠ সংবাদদাতা, কালের আলো:

করোনার ভারতীয় ধরন শনাক্ত হওয়ার পর ঢাকার বাইরে আক্রান্তের হার বাড়ছে দ্রুতগতিতে। বিশেষ করে দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর প্রত্যন্ত গ্রামেও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমান্ত এলাকার তুলনায় বর্তমানে রাজধানীতে আক্রান্ত রোগী ও শনাক্তের হার অনেকটাই কম। বলা যায়, এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে ঢাকার সংক্রমণ।

নতুন ‘হটস্পট’ হয়ে ওঠা জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, নাটোর, নোয়াখালী ও কক্সবাজার। এসব জেলায় করোনা বাড়ছে ব্যাপকহারে।

জেলাগুলোর কোথাও পূর্ণ এবং কোথাও আংশিক লকডাউন চলছে। ঢাকায় আক্রান্তের সংখ্যা এবং শনাক্তের হার এখন অনেক কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকায় আক্রান্ত বেশি। অনেকের মধ্যে রাজধানীর পঞ্চাশ লক্ষাধিক মানুষ ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

অসমর্থিত বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, এ সংখ্যা ১ কোটির বেশি হবে। রাজধানীতে করোনার টিকা দিয়েছেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ। আক্রান্ত এবং টিকা দেওয়ার কারণে এখানকার বড় একটি অংশের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।

এর বাইরে গত বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ ৫৪ শতাংশ গৃহকর্মী ও ১৯ শতাংশ নারী গার্মেন্টকর্মী চাকরি হারিয়েছে। করোনার ছোবলে চাকরিচ্যুত ও ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গ্রামে ফিরেছেন লাখ লাখ মানুষ।

যার কারণে ঢাকায় শনাক্তের হার কম বলেই মনে করছেন তারা। সংক্রমণ বাড়ার ধারায় গত এক দিনে দেশে আরও ২ হাজার ৫৩৭ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, যা দেড় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এর অধিকাংশ ঢাকার বাইরে। এর আগে গত ২৮ এপ্রিল এর চেয়ে বেশি ২ হাজার ৯৫৫ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ার কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আক্রান্তদের মধ্যে গত এক দিনে মৃত্যু হয়েছে আরও ৩৬ জনের।

করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ধরনের বিস্তারে সংক্রমণের নতুন ‘হটস্পট’ হয়ে ওঠা জেলাগুলোয় বিশেষ লকডাউন ঘোষণা করা হলেও সাধারণ মানুষের মাঝে স্বতঃস্ফূর্ততা না থাকায় ঢিলেঢালাভাবে পালিত হচ্ছে।

তবে আক্রান্ত এলাকায় অনেক হাসপাতালে শয্যা খালি নেই। করোনার জন্য নির্ধারিত শয্যার চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি। রয়েছে আইসিইউ ও অক্সিজেন সংকটও।

জানা গেছে, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে করোনা ইউনিটে আরও একটি ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। এরপরও ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগীর চাপ রয়েছে। খুলনা বিভাগে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। প্রতিদিনই বাড়ছে শনাক্ত আর আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা।

করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর চাপ। এখানে ধারণক্ষমতার বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় মোংলায় ১৬ জুন পর্যন্ত সময়সীমা বাড়িয়ে নতুন করে অধিক কঠোরতর বিধিনিষেধ জারি করেছে জেলা প্রশাসন।

যশোর জেনারেল হাসপাতাল তিন শয্যার আইসিইউ ইউনিট ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো লোকবল নেই। কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ প্ল্যান্ট বসানো হলেও এখনো চালু হয়নি। বাগেরহাটে ৫০ শয্যার কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ব্যবহার করার মতো ভেন্টিলেটর নেই। প্রশিক্ষিত জনবল না থাকায় তিনটি আইসিইউ বেড থাকলেও আইসিইউ চালু করা যাচ্ছে না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার ব্যাপক বিস্তার নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী যেসব জেলায় সংক্রমণ বেশি, সেখানে লকডাউন জোরদার করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক পরার ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।

এসব জেলায় নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি যাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাদের চিহ্নিত করার কার্যক্রম বাড়াতে হবে। যথাযথভাবে রোগী ব্যবস্থাপনা করতে হবে। নয়তো পরিস্থিতি খুব দ্রুতই বিপর্যের দিকে যাবে বলে শঙ্কা তাদের।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, আগে দেখেছি গ্রামে করোনার সংক্রমণ ছিল না। এবার দেখা যাচ্ছে গ্রামের মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। করোনার সংক্রমণ এখন যেসব জেলা-উপজেলায় বেশি হচ্ছে। সেসব শহর আমাদের ঢাকা বা চট্টগ্রাম শহরের মতো নয়। সেগুলো ছোট শহর। সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই গ্রামে থাকে। তারা শহরে এসে কাজ করে আবার গ্রামে চলে যায়। এসব ছোট শহরের অবস্থান করার মানুষ কম থাকে। করোনার সংক্রমণের এটি একটি কারণ হতে পারে।

তার মতে, সংক্রমণ প্রতিরোধে এখন এলাকাভিত্তিক লকডাউন নিশ্চিত করতে হবে। কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং ও পরীক্ষা করতে হবে। পরীক্ষায় যাদের মধ্যে করোনা শনাক্ত হবে তাদের আইসোলেশনে নিতে হবে এবং স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দিতে হবে। চিকিৎসা দ্রুত করতে হবে।

গত দেড় বছর ধরে বিশ্বজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যাওয়া করোনা ভাইরাস রূপ বদলাচ্ছে ক্রমাগত। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে এর বেশ কয়েকটি ‘মিউট্যান্ট’ বা পরিবর্তিত ধরন পাওয়া গেছে, যেগুলো অনেক বেশি সংক্রামক।

এর মধ্যে ভারতে গত বছরের শেষ দিকে একটি নতুন ধরন শনাক্ত হয়, যাকে এ বছর দেশটিতে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে রেকর্ড সংক্রমণ ও মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হচ্ছে। আলোচনার সুবিধার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে বলছে ‘ডেলটা’।

কালের আলো/ডিএসবি/এমএম