আগে জীবন, পরে অর্থনীতি : মহামারি মোকাবিলায় চীনের সফল নীতি
প্রকাশিতঃ 10:34 am | November 14, 2020

আলিমুল হক :
‘একমো’ মেশিনের নাম আমি শুনেছি এই সেদিন। সিজিটিএন (চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক)-এর একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখছিলাম। প্রামাণ্যচিত্রে উহানের এক হাসপাতালে কোভিডে আক্রান্ত একজন সিরিয়াস রোগীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। রোগী মধ্যবয়সী। বিভিন্ন ধরনের অসুখে আগেই ভুগছিলেন। এরপর গোঁদের ওপর বিষফোড়ার মতো কোভিড এসে তার ওপর ভর করে। হাসপাতালে নেওয়ার পর অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। আইসিইউতে কয়েকদিন রাখার পর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বুঝলেন যে, রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে একমো মেশিন লাগবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে একমো মেশিন নেই।
অত্যন্ত দামী এই ‘এক্সট্রাকরপোরিয়েল মেমব্রেন অক্সিজেনেশান’ (extracorporeal membrane oxygenation, ECMO) মেশিন। প্রামাণ্যচিত্র দেখে যেটুকু বুঝলাম, এই মেশিন মারাত্মকভাবে অসুস্থ রোগীর একাধারে হার্ট ও ফুসফুসের কাজ করে। যদি কোনো রোগীর হার্ট ও ফুসফুস ঠিকমতো কাজ না-করে, তখন এই মেশিনের সাহায্যে তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। এই মেশিন রোগীর রক্তকে কার্বন-ডাই-অক্সাইডমুক্ত করে বিশুদ্ধ রক্ত শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করে। তো, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক তার পরিচিত একজন পরিবেশকের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি মেশিন ধার নিলেন। সেই মেশিন হাসপাতালে এলো এবং রোগীকে মেশিনের সঙ্গে যুক্ত করা হলো। তারপর চলল যমে-মানুষে টানাটানি। শেষ পর্যন্ত যম জয়ী হলো। ডাক্তার বললেন: ‘জানতাম রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।’
প্রামাণ্যচিত্রের কাহিনীটা বলতে গেলে ভুলেই গিয়েছিলাম। সম্প্রতি একটি ঘটনা সেই কাহিনী মনে করিয়ে দিল। ঘটনাটি এমন: কোভিডে আক্রান্ত ৬২ বছর বয়সী আরেক রোগী মিস্টার লিউ-কে চীনা ডাক্তাররা একটি ‘একমো’ মেশিনের সাহায্যে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন ১১১ দিন বা প্রায় ৪ মাস। তারচেয়েও বড় কথা, দীর্ঘদিন একমো মেশিনের সাহায্যে বেঁচে থাকার পর তিনি পুরোপুরি সুস্থও হয়ে ওঠেন। তার অবস্থা এতোটাই খারাপ ছিল যে, একমো মেশিন থেকে ছাড়া পাবার পরও তাকে আরও ১৫০ দিন কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের সাহায্য নিতে হয়েছে। বলা হচ্ছে, এতো দীর্ঘসময় একমো মেশিনের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর বেঁচে ওঠার ঘটনা পৃথিবীতে এটাই প্রথম!
মিস্টার লিউ চিকিৎসা পেয়েছেন চীনের কুয়াংতুং প্রদেশের কুয়াংচৌ চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতাল থেকে এই হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। শুরুতে তাকে আইসিইউ-তে নেওয়া হয় এবং ৯ ফেব্রুয়ারি তাকে একমো মেশিনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। মিস্টার লিউ ওভারওয়েট ও হার্টের রোগী। উচ্চ রক্তচাপসহ অন্যান্য সমস্যাও ছিল। কোভিড-১৯ তার অবস্থা আরও খারাপ করে দেয়। এ অবস্থা থেকে তাকে বাঁচিয়ে তোলা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। প্রায় অসম্ভব কাজকে সম্ভব করার প্রথম পদক্ষেপ ছিল তাকে একমো মেশিনে সংযুক্ত করা। একমো মেশিন তার কাজ করেছে। কিন্তু পাশাপাশি লিউ-কে বাঁচিয়ে রাখতে দিনরাত কাজ করেছেন হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরা। হাসপাতালের পরিচালক লিউ সিয়াওছিং বলেন: ‘রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যত্ন।’ মেশিন ও মানুষের যত্নে শেষ পর্যন্ত মিস্টার লিউ সুস্থ হয়ে ওঠেন, সৃষ্টি করেন বিশ্বরেকর্ড!
প্রামাণ্যচিত্রের সেই রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে একজন চীনা ডাক্তারের আপ্রাণ চেষ্টা এবং মিস্টার লিউকে বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করে বাঁচিয়ে তোলার ঘটনা শুধু দু’টি উদাহরণ মাত্র। উহানে নভেল করোনাভাইরাসের তাণ্ডব শুরু হবার পর থেকে চীনের বিভিন্ন হাসপাতালে এমন আরও ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর কোনো কোনোটি গণমাধ্যমে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে, আবার কোনো কোনোটি আসেনি। সব ঘটনার মূলে ছিল চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের একটি নীতি: ‘আগে যে-কোনো মূল্যে মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে’। উহানে মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই এই নীতি অনুসারে চলেছে গোটা চীন।
১৪০ কোটি মানুষের বিশাল দেশ চীন; বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। এ দেশের জনসাধারণ ও সরকার জানে অর্থনীতির চাকা চালু রাখার গুরুত্ব কতোটা। কিন্তু অর্থনীতির ওপর স্থান দেওয়া হয় জীবনকে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে উহান লকডাউন করা হয়। পরে আশেপাশের আরও কয়েকটি শহরকে লকডাউন করা হয়। শুরু হয় গণহারে টেস্টিং, ট্রেসিং, আইসোলেটিং ও ট্রিটমেন্টের কাজ। বিনামূল্যে আক্রান্তদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়। শুধু জীবন বাঁচানোর তাগিদেই উহানে অল্প কয়েক দিনের মধ্যে নির্মাণ করা হয় হাজার শয্যার দুটি অস্থায়ী হাসপাতাল। আবার লকডাউনের পর শুধু জীবন বাঁচানোর জন্যই গোটা চীন থেকে প্রয়োজনীয় সম্পদ এনে নিয়োজিত করা হয় উহান ও এর আশেপাশের শহরগুলোতে। চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনা ছিল এক্ষেত্রে স্পষ্ট: যে-কোনো মূল্যে জীবন বাঁচাতে হবে।
জীবন বাঁচাতে গিয়ে চীনের অভ্যন্তরে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ও তার বাস্তবায়ন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মহামারির বিস্তারের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই দেখা দেয় চীনের অর্থনীতিতে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো চীনের অর্থনীতিতেও একধরনের স্থবিরতা চলে আসে। যে-দেশের অর্থনীতিতে ৬ বা তার বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ফিবছর, সেদেশের অর্থনীতি মহামারির কারণে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে সংকুচিত হয় প্রায় সাড়ে আট শতাংশ। মনে পড়ে, তখন পশ্চিমা মিডিয়াতে এ নিয়ে আলোচনায় কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এমনও বলেছিলেন যে, চীনের অর্থনীতি বহু বছরের জন্য মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে। কোনো কোনো মার্কিন রাজনীতিবিদ এই বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলেন যে, সকল ব্যবসা-বাণিজ্য চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাবে!
আশঙ্কা যারা প্রকাশ করেছিলেন, তাদের সবাই একশ্রেণির মার্কিন রাজনীতিবিদের মতো নন। তাদের অনেকেই প্রকৃত অর্থেই চীনা অর্থনীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তারা জানেন যে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনা অর্থনীতির অবদান কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি সাধারণ মানুষ। আমিও উদ্বিগ্ন ছিলাম মহামারির নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে। কিন্তু শত আশঙ্কার মধ্যেও চীনের সরকার ‘মানুষের জীবন যে-কোনো মূল্যে বাঁচাতে হবে’—এই মূলনীতি থেকে সরে আসেনি। মহামারি শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত চীনের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে ওই মূলনীতির ভিত্তিতে।
এর ফল কী হয়েছে? বছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থনীতি ৮ শতাংশের বেশি সংকুচিত হয়েছে। কিন্তু চীন সাফল্যের সঙ্গে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতেও সক্ষম হয়েছে! মহামারিতে চীনে মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়ায়নি; আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়ায়নি লাখের কোঠা! পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের কথা ভাবুন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মানুষের জীবনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন দেশের অর্থনীতির ওপর; নির্বাচনের ওপর; নিজের স্বার্থের ওপর। এর ফল হয়েছে করুণ। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি, চিকিৎসা-বিজ্ঞানে বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসর দেশ যুক্তরাষ্ট্রে মহামারিতে মৃতের সংখ্যা আড়াই লাখ ছুঁই ছুঁই করছে; আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ। দেশটিতে যখন নির্বাচনী প্রচারাভিযান চলছিল, তখন টানা কয়েকদিন দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা লাখের কোঠা অতিক্রম করে। এটা আমার কথা নয়, খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের অভিমত এই যে, শুধু মাস্ক পরে, সামাজিক দূরত্ব অনুশীলন করে দেশটিতে লাখো মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব ছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে মানুষের জীবন বাঁচানো অগ্রাধিকার পায়নি।
মানুষের জীবন বাঁচানোকে অগ্রাধিকার না-দিয়ে ট্রাম্প অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, নিজের পুনঃনির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কিন্তু এ কৌশল কাজে লাগেনি। একদিকে মানুষের জীবন গেছে, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিও মুখ থুবড়ে পড়েছে; বেকার হয়েছে লক্ষ-কোটি আমেরিকান। আর সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হয়েছে নির্বাচনে। মূলত মহামারি মোকাবিলায় ব্যর্থতার কারণে তিনি জো বাইডেনের কাছে হেরেছেন। আমার বিশ্বাস, যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প মানুষের জীবন বাঁচানোকে অগ্রাধিকার দিতেন, তবে নির্বাচনে তার পরাজয় ঘটতো না। বস্তুত, যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচন ছিল অনেকটা গণভোটের মতো। ট্রাম্পের মহামারি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতাকে ভোটাররা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটেছে চীনে। মানুষের জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে চীনে মহামারি নিয়ন্ত্রণে এসেছে; আক্রান্তের সংখ্যা সীমিত থেকেছে; মৃতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়েছে। চীনা জনগণ এ জন্য তাদের সরকারের প্রতি সন্তুষ্ট। ৯০ শতাংশের বেশি চীনা মনে করেন, সরকার মহামারি নিয়ন্ত্রণে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছে। আসলে, শুধু চীনারা নয়, এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা অকাতরে চীনা সরকারের প্রশংসা করছেন। তাদের একজন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সাবেক প্রফেসর উইলিয়াম হ্যাসেলটাইন। তিনি সম্প্রতি সিএনএন-এ এক সাক্ষাৎকারে চীনের প্রশংসা করেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল: যুক্তরাষ্ট্রে কি মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? তিনি উত্তরে বলেছিলেন: ‘সম্ভব। কারণ, চীন সেটা করে দেখিয়েছে। এটা ঠিক যে, চীনের সমাজব্যবস্থা ও জনগণের আইন মেনে চলার প্রবণতা সেদেশের সরকারকে মহামারি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা ভিন্ন। তবে, চীন এটা প্রমাণ করেছে যে, এই মহামারির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’
মানুষের জীবন বাঁচানোকে অগ্রাধিকার দিয়ে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ও সেগুলোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে চীনের সরকার মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এতে অসংখ্য মানুষের জীবন বেঁচেছে (যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়)। কিন্তু এতে চীনের অর্থনীতি তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি! মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসার পর চীনের অর্থনীতিও দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। বিভিন্ন কল-কারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক হতে বেশি সময় লাগেনি। বিদেশে পণ্য রফতানিও বাড়তে থাকে ক্রমশ। এখন তো আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস হচ্ছে: চলতি বছর বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র চীনেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে!
একটি দেশের মানুষ যখন সুস্থ থাকে, তখন সেদেশের অর্থনীতিও সুস্থ থাকে। চীন ১৪০ কোটি মানুষের দেশ। চীনে আছে ৪০ কোটি মধ্যবিত্তের বিশাল বাজার। দেশটির অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ ভোগের পরিমাণ আগেই পঞ্চাশ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। মহামারির কারণে সেটা আরও বেড়েছে। মহামারির শুরুর দিক থেকে শুরু করে মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসার আগ পর্যন্ত একটা লম্বা সময় চীনাদের অবাধ চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আর মানুষের চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়া মানে অর্থনীতির চাকার গতি কমে যাওয়া। কিন্তু মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসার পর ধীরে ধীরে মানুষের চলাচলও বাড়তে থাকে; বাড়তে থাকে মানুষের ভোগের পরিমাণ। এতে অর্থনীতির চাকাও আরও জোরে ঘুরতে শুরু করে।
তবে, অক্টোবরের শুরুতে চীনের সরকার ও জনগণ সবচেয়ে বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়; প্রমাণিত হয় যে, চীন সত্যি সত্যিই মহামারির বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। অক্টোবরের শুরুতে জাতীয় দিবসের এক সপ্তাহের ছুটিতে চীনের ৬৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভ্রমণ করেন। এসময় তাঁরা কেনাকাটায়ও ব্যয় করেন ৬৯০০ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ। ছুটির এই এক সপ্তাহকে চীনারা ডাকেন ‘স্বর্ণসপ্তাহ’ নামে। এই স্বর্ণসপ্তাহে ট্রেনে, বাসে, প্লেনে ছিল যাত্রীদের প্রচণ্ড চাপ। যানবাহনে যাত্রীদের সবাই বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরেছেন। তবে, খোলা জায়গায় অনেককেই মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। সিএনএনের রিপোর্টার স্বর্ণসপ্তাহে কোটি কোটি মানুষের চলাচলের ওপর রিপোর্ট করতে গিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের এই চলাচলের ফলে কেউ নতুন করে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে শোনা যায়নি!
আমি স্বর্ণসপ্তাহে বেইজিংয়ের বাইরে যাইনি। তবে, ছেলেকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম। চিড়িয়াখানায় একটা সি-অ্যাকুরিয়াম আছে। সেখানে বিশাল বিশাল চৌবাচ্চায় ক্ষুদ্র থেকে বিশালাকৃতির সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণীর সমাবেশ। দর্শণার্থীদের সংখ্যা বিপুল। মূল প্রদর্শনস্থলে প্রবেশ করে দেখি মানুষ আর মানুষ! বিশেষ করে ডলফিনের খেলা দেখায় যেখানে, সেখানে। বিশাল একটা স্টেডিয়াম। কিছুক্ষণের মধ্যে স্টেডিয়ামটি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল! সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই। অধিকাংশের মুখে অবশ্য মাস্ক আছে। কিন্তু অনেকের মুখে নেই! ছেলের আবদার রাখতে গিয়ে কিছু খাবার কিনে খেতেও হলো। খাওয়ার সময় তো মাস্ক খুলতে হয়! দু’ঘন্টার ডলফিনের খেলা দেখার পর বের হয়ে আমার মনে ভয় ঢুকে গেল। কয়েক হাজার মানুষের অনেকেই তো মাস্ক পরা ছিল না! তাদের কারুর কাছ থেকে ভাইরাসে আক্রান্ত তো হতে পারি! আমি মনে মনে দিন গুনতে লাগলাম। ১৪ দিন পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম: যাক বাবা, ভাইরাসে আক্রান্ত হইনি!
আমি যখন এই লেখা লিখছি, তখন যু্ক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়ার অনেক দেশে মহামারির বিস্তার বাড়ছে। ইউরোপের কোনো কোনো দেশে নতুন করে লকডাউন জারি করা হয়েছে; আবার কোনো কোনো দেশে রীতিমতো কারফিউ চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন দৈনিক এক লাখের বেশি লোক ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন; প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন কয়েক শত লোক। অথচ গোটা চীনে কোভিড রোগী আছে হাতে গোনা কয়েকজন! আমরা জানি, মহামারি চীনে সবার আগে আঘাত করেছে। ভাইরাস চীনকে পেয়েছিল অপ্রস্তুত অবস্থায়। অপ্রস্তুত অবস্থায়ও স্রেফ যথাযথ ব্যবস্থা (এসব ব্যবস্থা আবার শুরুর দিকে পশ্চিমাদের দ্বারা তীব্রভাবে সমালোচিতও হয়েছে!) গ্রহণের ফলে চীনে আক্রান্তের সংখ্যা ৯০,৯০০-এ সীমাবদ্ধ আছে; মৃতের সংখ্যাও ৪,৭৩৯-এ এসে থেমে আছে বিগত কয়েক মাস ধরেই! আমি ভাবি, যদি যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের ধনী দেশগুলো চীনের মতো মানুষের জীবন বাঁচানোকে শীর্ষস্থানে রেখে যথাযথ ব্যবস্থাদি গ্রহণ করতো, তবে আজ এসব দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেঁচে যেতেন; এসব দেশের অর্থনীতির চাকাও চীনের মতো দ্রুতলয়ে ঘুরতে শুরু করতো। চীন প্রমাণ করেছে যে, সুস্থ জনগণ মানে সুস্থ অর্থনীতি।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।