বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি: রিভিউ আবেদনের আদেশ রোববার

প্রকাশিতঃ 4:41 pm | June 26, 2025

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো: 

বিচার বিভাগ পৃথককরণ সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলায় বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধির রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষ হয়েছে; আগামী রোববার আদেশের জন্য রাখা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ আদেশের জন্য এদিন ধার্য করে।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশ করে সরকার। ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি তা গ্রহণ করে আপিল বিভাগ।

এই বিধির মাধ্যমে অধস্তন আদালতের বিচারকদের আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বলে। এর ফলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, ছুটি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে যায়।

আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, “সেই শৃঙ্খলাবিধিকে পুনর্বিবেচনা চেয়ে আমরা আবেদন করেছিলাম। আজকে সেই আবেদনের শুনানি হয়েছে। আমাদের বক্তব্য মাননীয় প্রধান বিচারপতি মনযোগ দিয়ে শুনেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যও শুনেছেন। আমাদের আরও কিছু গ্রাউন্ড দিতে বলেছেন। আগামী রোববার আদেশের জন্য নির্ধারিত আছে। আসবে বিশেষ বেঞ্চ আকারে।”

শুনানির বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা বলেছি বিচার বিভাগকে ‘অ্যাসল্ট করে’ এই শৃঙ্খলাবিধিকে গ্রহণ করা হয়েছিল ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে। আগে নয়জন বিচারপতি ভিন্ন আদেশ দিয়েছিলেন। পরে প্রধান বিচারপতিকে অপসারণ এবং ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করে পাঁচজন বিচারপতির মাধ্যমে সেই শৃঙ্খলাবিধি গ্রহণ করে ফেলা হয়েছিল।

“আমরা বলেছি, এটি বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন। বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে তৎকালীন সরকার বাধ্য করেছিল এ আদেশ দিতে। এটি দ্রুত রিভিউ করা প্রয়োজন।”

সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ব্যাপারে শিশির মনির বলেন, “তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তার ‘ব্রোকেন ড্রিম’ বইয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। একদিন দেখা গেল তিনি আদালতে ওঠেননি। বলা হয়েছিল তিনি অসুস্থ, বাড়িতে আছেন। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা সরকারকে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি কোথায়, তখন সরকারের পক্ষে বলা হয়েছিল তিনি অসুস্থ। পরে খবর নিয়ে জানা গেল তিনি অসুস্থ নন। তিনি নিজেও বলেছিলেন, তিনি অসুস্থ নন।”

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চলতি বছর বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব। এতে বিবাদী করা হয় মাসদার হোসেন ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের।

১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ মাসদার হোসেন মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয়। এই রায়ের আলোকে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়।

ওই রায়ের আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল।

১২ দফা নির্দেশনার মধ্যে ছিল-

>> সংবিধানের ১৫২ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সব বিভাগের কাজ সার্ভিস অব রিপাবলিকের ভেতরে পড়বে। তবে বিচার বিভাগের কাজ ও অবকাঠামোর সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসের অনেক ভিন্নতা রয়েছে। বিচার বিভাগকে অন্যান্য সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে একত্রিত করা যাবে না।

>> বিচারিক হাকিমদের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা এবং নির্বাহী বিভাগের হাকিমরা বিচারিক কাজ করতে পারবেন না।

>> সিভিল সার্ভিস অর্ডার ১৯৮০ অনুযায়ী, সব হাকিমকে পিএসসির অধীনে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া হয়। একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থি।

>> এই রায় পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা এবং কমিশন গঠন করতে হবে।

>> সংবিধানের ১১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়ারির সবার চাকরির বিধিমালা (নিয়োগ, পদায়ন, বদলি পদোন্নতি ও ছুটিসহ অন্যান্য) প্রণয়ন করবেন।

>> রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন করবেন।

>> সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে।

>> বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকবে না এবং বিচারিক হাকিমসহ সব বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করবেন।

>> জুডিশিয়ারির (নিম্ন আদালত) বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনো হাত থাকবে না। এই বাজেট সুপ্রিম কোর্ট প্রণয়ন এবং বরাদ্দ করবে।

>> জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা প্রশাসনিক আদালতের আওতাভুক্ত থাকবেন।

>> এই রায় অনুযায়ী বিচার বিভাগ পৃথককরণের জন্য সংবিধানে কোনো সংশোধন করার প্রয়োজন নেই। তবে পৃথককরণ আরও অর্থবহ করতে যদি সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তবে তা করা যাবে।

>> জুডিশিয়াল পে-কমিশন: জুডিশিয়াল পে-কমিশন জুডিশিয়ারির সদস্যদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ না করবে, ততদিন পর্যন্ত বর্তমান অবকাঠামো অনুযায়ী তার সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।

জুডিসিয়াল সার্ভিসকে সিভিল সার্ভিসে অন্তর্ভুক্তি চ্যালেঞ্জ করে বিচার বিভাগ আলাদা করার নির্দেশনা চেয়ে ১৯৯৫ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করে জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।

সমিতির তখনকার নেতা হিসেবে বিচারক মাসদার হোসেন এই আবেদনে বাদী ছিলেন বলে তার নামেই মামলাটি পরিচিতি পায়।

কালের আলো/এমডিএইচ