স্বল্প খরচে নবজাতকের জীবন রক্ষায় সাফল্য দেখাল সোয়াপ প্রকল্প
প্রকাশিতঃ 8:18 pm | June 16, 2025

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, কালের আলো:
দেশের স্বাস্থ্য খাতে নবজাতকের জীবন রক্ষায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সেভ দ্য চিলড্রেনের যৌথ উদ্যোগ “সেভিং উইমেন অ্যান্ড প্রিম্যাচিউর বেবিজ” (সোয়াপ) প্রকল্প। সীমিত বাজেটের মধ্যেই উন্নত প্রযুক্তি ও পরিবার কেন্দ্রিক চিকিৎসার পদ্ধতি প্রয়োগ করে তিন বছর ধরে দেশের পাঁচটি জেলায় ১ লাখ ৬৫ হাজার গর্ভবতী মা ও ৮৭ হাজার নবজাতকের সেবা নিশ্চিত করেছে এই প্রকল্প।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরিণত নবজাতকের জন্ম ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসে সোয়াপের মতো কম খরচে আধুনিক প্রযুক্তির বিস্তার টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মাইলফলক স্থাপন করবে। এর পাশাপাশি পরিবারকেন্দ্রিক চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে নবজাতকের যত্নে পরিবারের ভূমিকা নিশ্চিত করাও দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সোমবার (১৬ জুন) বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ডা. মিল্টন হলে নিওন্যাটোলজি বিভাগ ও সেভ দ্যা চিলড্রেন আয়োজিত এক সভায় এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
অনুষ্ঠানে সোয়াপ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. ইসমত জাহান।
জানা গেছে, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর সময় ধরে পরিচালিত এই প্রকল্পটি সেভ দ্য চিলড্রেনের নেতৃত্বে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ), সিপিআরবি, ভায়ু গ্লোবাল হেলথ ফাউন্ডেশন এবং লেয়ার্ডাল গ্লোবাল হেলথের সহযোগিতায় বাংলাদেশে মাতৃ ও নবজাতক মৃত্যুহার কমানোর লক্ষ্যে কাজ করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা, লক্ষ্মীপুর ও সিলেট জেলায় পাঁচটি হাসপাতালে অপরিণত ও অসুস্থ নবজাতকের চিকিৎসা ও গর্ভবতী নারীর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার উন্নত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের প্রসঙ্গে অপরিণত নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু কমানো এক অতি জরুরি চ্যালেঞ্জ। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ নবজাতকের মধ্যে প্রায় ১৬ শতাংশই অপরিণত শিশুর জন্ম হয়, যা তুলনামূলকভাবে বিশ্বের উচ্চতম হারগুলোর মধ্যে অন্যতম।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে বলা হয়, সোয়াপ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল গর্ভাবস্থার জটিলতা দ্রুত শনাক্ত ও সঠিক চিকিৎসা প্রদান, নবজাতকের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতকরণ, নতুন ও উদ্ভাবনী চিকিৎসা প্রযুক্তির বিস্তার, স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে সহায়তা এবং পরিবারকে নবজাতকের যত্নে সম্পৃক্ত করে পরিবার কেন্দ্রিক চিকিৎসা পদ্ধতি চালু করা। এই লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটি নানা কার্যক্রম ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে।
ডা. ইসমত জাহান জানান, সোয়াপ প্রকল্পের অন্যতম প্রধান সাফল্য হলো সরকার অনুমোদিত বিভিন্ন কার্যকর ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ। ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ব্যবহার করে ইক্লাম্পসিয়া প্রতিরোধ এবং চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে, যা মাতৃমৃত্যুর হার ব্যাপকভাবে কমিয়েছে। অপরদিকে, অ্যান্টিনাটাল কর্টিকোস্টেরয়েডস ব্যবহার অপরিণত শিশুর ফুসফুসের উন্নয়নে সাহায্য করে তাদের শ্বাসকষ্ট কমিয়েছে। প্রিম্যাচিউর প্রসব ও সংক্রমণ প্রতিরোধে নিফিডিপাইন ও এরিথ্রোমাইসিন ব্যবহার প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। এছাড়াও ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতি শিশুদের ত্বক-টু-ত্বক সংস্পর্শ, স্তন্যপান ও হাসপাতাল থেকে মুক্তির পর বাড়িতে পর্যবেক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
তিনি জানান, নবজাতকের শ্বাসকষ্ট কমাতে স্বল্প বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায় এমন ‘ভায়ু bCPAP’ নামের একটি পোর্টেবল বুদবুদ সিপ্যাপ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, যা বিশেষভাবে সাহায্য করেছে বিদ্যুৎ অনুপস্থিত বা সীমিত বিদ্যুৎ পরিবেশে। নবজাতকের পুনর্জীবনের জন্য ‘নিওন্যাটালি লাইভ’ নামের উচ্চমানের সিমুলেটর ব্যবহার করে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যা সেবার মান ও দক্ষতা উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর পাশাপাশি, ফ্যামিলি সেন্টারড কেয়ার পদ্ধতির মাধ্যমে নবজাতকের যত্নে পরিবারের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে, যা হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা ও সেবার গুণগত মান বৃদ্ধিতেও সহায়ক হয়েছে।
সেবা প্রসঙ্গে তিনি আরও জানান, সোয়াপ প্রকল্প ১ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি গর্ভবতী নারীকে সেবা প্রদান করেছে এবং ৮৭ হাজারের অধিক নবজাতক উন্নত চিকিৎসা পেয়েছে। ১ হাজার ৫০০ জনের বেশি স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএমইউ’র উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, সামগ্রিকভাবে সোয়াপ প্রকল্প প্রমাণ করেছে, সাশ্রয়ী ও কার্যকর প্রযুক্তি প্রয়োগ, পরিবারকে সম্পৃক্ত করা ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন একসাথে করা গেলে নবজাতকের জীবন রক্ষা সম্ভব। বিদ্যুৎবিহীন পোর্টেবল যন্ত্র যেমন ভায়ু bCPAP, উন্নত প্রশিক্ষণ প্রযুক্তি ও পরিবার কেন্দ্রিক চিকিৎসা পদ্ধতি দেশীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ মহামারী, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ ও গড় আয়ু বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। এখন নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস জাতীয় অগ্রাধিকার। সোয়াপ প্রকল্পের সফলতা দেখিয়েছে সঠিক পরিকল্পনা, উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং পরিবারের সম্পৃক্ততা থাকলে ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। সরকারের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মী ও জনগণ মিলে এ লক্ষ্যে কাজ করলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত আরও শক্তিশালী ও উন্নত হবে।
সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ, উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদার, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার, শিশু অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. মো. আতিয়ার রহমান। সভায় প্যানেল ডিসকাশন পর্ব সঞ্চালনা করেন বিএমইউ’র নিওন্যাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল মান্নান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাদেকা চৌধুরী মনি।
কালের আলো/এসএকে