কথিত আরব বসন্ত কী ইরানের দুয়ারে দাঁড়িয়ে?

প্রকাশিতঃ 11:22 am | June 16, 2025

জান্নাতুল বাকেয়া কেকা:

ফিলিস্তিনে জাতিগত নিধন প্রায় সম্পন্ন, এবার ইরানের পালা! পাশে নেই মুসলিম বিশ্ব! ইসলামের নামে কট্টরপন্থী ইরানেও কথিত পরিবর্তনে আরব বসন্তের সূচনা হবে কী? সম্ভাবনা প্রবল! ইরাক সেই কবেই হারিয়েছে তার সম্ভ্রান্ত জাতি সত্তার গৌরব। লিবিয়ার গাদ্দাফি সরব হয়েছিলেন আফ্রিকার দেশে দেশে পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদের নখর উপরে দিতে। আফ্রিকান ইউনিয়নভক্তু দেশগুলোকে নিয়ে অভিন্ন মুদ্রা “স্বর্ণ দিনার” চালুর কথা জোরে-শোরে ঘোষণা দিয়ে মাঠেও নামেন তিনি।

কথিত আরব বসন্তের নামে বাশার আল আসাদের ক্ষমতাচ্যুতি নিকট সম্প্রতির ঘটনা। বাশার আল আসাদ প্রাণে বেঁচেছেন বটে। তবে সিরিয়া আজ ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর গৃহযুদ্ধ কবলিত এক জনপদ। হালের ফিলিস্তিন জনগোষ্ঠীর মানুষেরাও প্রায় নিশ্চিহ্নের পথে। এবার মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর ইরানকেও মুছে দেবার চেষ্টা! তবুও মুসলিম বিশ্বের টনক নড়ে না।

দ্রুতই পশ্চিমা তথা ফ্রান্স ঔপনিবেশ কলোনির মহা প্রভুদের চক্ষুশূল হন গাদ্দাফী। এর ভয়াল পরিণতিতে আমরা দেখেছি কথিত ফ্যাস্টিস্টের নামে কর্নেল গাদ্দাফিকে পথের কাঁটা গণ্য করে পশ্চিমা বিশ্ব নিশ্চিত মৃত্যুর নীল নকশায় শূলবিদ্ধ করে। মৃত্যু অনিবার্য তথাপিও আফ্রিকার শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরব এক কর্নেল গাদ্দাফির ভাগ্যে জোটে হৃদয়হীন নির্মম মৃত্যু। যে মৃত্যুর লিখন খণ্ডন করেনি তাঁর ভাগ্য ললাট। বরং বড় অসম্মান ও ব্যথাতুর দীর্ঘ বঞ্চনা, অসম্মানের মৃত্যুর দৃষ্টান্ত হয়ে আছে! আফ্রিকার জনমানসের মুক্তির নেতা সংগ্রামী কর্নেল গাদ্দাফির মৃত্যুতে দেশটির আমজনতা আজ ভাগ্যহত দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে।

সিরিয়ার ভাগ্যেও ব্যতিক্রম হয় নি। কথিত আরব বসন্তের নামে বাশার আল আসাদের ক্ষমতাচ্যুতি নিকট সম্প্রতির ঘটনা। বাশার আল আসাদ প্রাণে বেঁচেছেন বটে। তবে সিরিয়া আজ ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর গৃহযুদ্ধ কবলিত এক জনপদ। হালের ফিলিস্তিন জনগোষ্ঠীর মানুষেরাও প্রায় নিশ্চিহ্নের পথে। এবার মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর ইরানকেও মুছে দেবার চেষ্টা! তবুও মুসলিম বিশ্বের টনক নড়ে না।

ধরণীর তলে অতীব অন্যায়ের চাষ হচ্ছে। বুড়ো খ্যাপাটে যুদ্ধবাজেরা স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র ফিলিস্তিন জনগেষ্ঠীকে ইতোমধ্যে নিশ্চিহ্ন করেছে। পৃথিবীর মানচিত্রে মানবিকতা নামক শব্দের ব্যবহার আজ গোষ্ঠীবদ্ধ। বৃহস্পতিবার রাত থেকে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর কট্টর শিয়া অধ্যুষিত রাষ্ট্র ইরানে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে পশ্চিমাদের লাঠিয়াল ইজরায়েল৷ কোনো মুসলিম দেশ বিশ্বের অপরাপর কোনো দেশে হামলা চালালে দেশটির পরিণতি কি হতো? ২০০২ সালে ইরাক কুয়েত আক্রমণ করে সেই নজির রেখে গেছে। এর বাইরে মুসলিম হলেই জঙ্গি রাষ্ট্রের তকমায় একঘরে হতো।

বৃহস্পতিবার ইজরায়েলের সেই হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, রেভ্যুলেশনারি গার্ড এর কমান্ডার হোসেইন সালামি নিহত হন। এছাড়াও আইঅরজিসির খাতাম-আল আনবিয়া সেন্ট্রাল হেডকোয়ার্টার্সের প্রধান গোলামালি রাশিদের মৃত্যু হয়েছে। মারা গেছেন আইআরজিসির এরোস্পেস ফোর্স বা বিমান ও মহাকাশ সংশ্লিষ্ট বাহিনীর প্রধান আমির আলি হাজিযাদেহ। প্রাণ হারিয়েছে ইরানের পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান পরমাণু বিজ্ঞানী ফেরেইদুন আব্বাসি।

দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ছয় পরমাণু বিজ্ঞানীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ইজরায়েলের হামলা। তাদের অন্যতম তেহরানের আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি। ইরানের শহিদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান আবদুল্লাহামিদ মিনৌচেহর। শহিদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আহমেদ রেজা জোলফাঘারি, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আমির হোসেইন ফেকহি এবং বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাও নিহত হন!

পুরো বিশ্ব নিশ্চুপ। কেউ পাশে নেই। প্রতিবাদের ভাষা আজ নীরব। ইরানের এককালের মিত্র চীনই খানিক ইরানের পক্ষে সরব। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে শুক্রবার ইরানে ইজরায়েলের হামলার তীব্র নিন্দা করেছে চীন। ১৩ জুন শুক্রবার জাতিসংঘে চীনের দূত ফু কং ইরানের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং ‘অভ্যন্তরীণ অখণ্ডতা’ লঙ্ঘনের নিন্দা তীব্র জানান। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে তিনি বলেন, আমরা ‘বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন’ এ কারণে যে ইজরাইল পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করছে। এটিকে তিনি ইজরাইলের ‘আরেকটি রেড লাইন’ অতিক্রম বলে মন্তব্য করেন। উত্তেজনা এড়াতে তিনি ইজরাইলকে অবিলম্বে সব সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ করার আহ্বান জানান। ‘পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে ইরানের পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের অধিকারকে সম্পূর্ণরূপে সম্মান করা উচিত’ বলেও মন্তব্য করেছে চীন।

এই যখন অবস্থা তখন ইরানের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। ইরান মুসলিম রাষ্ট্র হয়েও চারপাশের প্রতিবেশীর সাথে ভালো সম্পর্ক রাখেনি৷ দেশটিতে শিয়া-সুন্নির বিভেদ ছাড়াও কট্টর ইসলামী শাসনের নামে নারীদের কঠোরভাবে দমন-পীড়ন করে নারীর জীবনধারণ সীমিত ও অমানবিক করেছে৷ যদিও সাধারণ সুন্নি মুসলিমদের তুলনায় শিয়া মুসলিমরা জ্ঞানে বিজ্ঞানে এগিয়ে। তথাপিও শিরা প্রধান ইরানে নারী অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে চরম ভাবে !

১৯৭৯ সালে এক বিপ্লবের মাধ্যমে পাশ্চাত্য পাহলভি রাজবংশের পতন হয়। যদিও এই বিপ্লবের ফলে ইরানের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের স্থলাভিষিক্ত হয় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান। মোহাম্মদ রেজা পাহলভির রাজতান্ত্রিক সরকারকে বিদ্রোহী গোষ্ঠী উৎখাত করে ধর্মীয় নেতা রুহুল্লাহ খোমেনি কর্তৃক প্রতিস্থাপিত হয় । ইরানের শেষ শাহ পাহলভির উৎখাতের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ইরানের ঐতিহাসিক রাজতন্ত্রের অবসান ঘটেছে বটে তবে কট্টরপন্থী শাসনে-শোষণে ইরানের নাগরিক সমাজ ও জীবন নানান ঘেরাটোপে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। নারীর অধিকার চরমভাবে খর্ব ও লঙ্ঘিত হয়।

ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং নারীদের মর্যাদা নানান ভাবে স্বীকৃত। তথাপিও ভিন্ন মত ও মতাদর্শধারী ও সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশ নারীদের দমন-পীড়ন চলেছে। ফলে শান্তির ধর্ম ইসলামে মহানুভবতা, উদার ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে ইরান নিজ দেশের জনগণের কাছে খু্ব জনবান্ধব রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে নি। আর এই বিষয়টি সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা আগ্রাসনের নয়া সুযোগ হিসেবে ক্যাচ করেছে। নিজ দেশেই ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খোমেনির নেতৃত্বাধীন শাসন দমন-পীড়নে হররান, হতাশ ও দীর্ঘদিনের নৈরাজ্যে আশাহত দেশবাসী।

ইজরায়েল ইরানকে তার জন্য হুমকি মনে করে। সেই অজুহাতে পারমাণবিক শক্তির কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া রাষ্ট্র ইরানের মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দিতে তৎপর ভাবা যায়? একটি স্বাধীন দেশের উপর অতর্কিত হামলা ন্যূনতম সভ্যতা বিবর্জিত চর্চা। আর সেই চর্চাই করে চলেছে ইজরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ধর্মীয় বিভেদ, গোষ্ঠীগত আর স্বার্থের দড়ি নানান মতবাদে বিভক্ত। মিশর, লেবানন, জর্দান, ইরাক, সৌদি আরব একেকটি দেশ একেক দিকে৷ ইরানে হামলায় দেশগুলোর কোনো মাথাব্যথা নেই কী অদ্ভুত?

আবার নিজ দেশের অভ্যন্তরে কট্টর ধর্মতন্ত্র ও ভিন্নমতের উপর দমন পীড়নের কারণে নিজ দেশে জনগণও শাসকদের প্রতি বেজায় বিমুখ। লাঠিয়াল ইজরায়েলের হাতে দফায় দফায় আক্রান্ত হলেও ইরান ঘরে-বাইরো বন্ধুহীন। নিজ দেশের নাগরিকেরা ইরানের শাসককূলের হাতে এতটা নিষ্পেষিত যে, দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হওয়ার মুখেও নির্বিকার দেশটির সাধারণ জনমানুষ।

আর ঠিক এই সুযোগটিই লুফে নিয়েছেন পম্চিমা সাস্রাজ্যবাদী পরাশক্তির লাঠিয়াল সর্দার নেতানিয়াহু। তাই হয়তো তিনি সদর্পে বলেছেন, “ইরানের জনগণ তার শত্রু নয়।” এর মানে তথাকথিত আধ্যাত্মিক নেতা খোমেনির নেতৃত্বে কট্টরপন্থী ইরানের রাষ্ট্র কাঠামোই ইজরায়েলের অন্যতম শত্রু? সাধারণ জনগণ নন। এতে বেশ বোঝা যায় ইরানের সাধারণ আমজনতা দীর্ঘ দিন সাফোকেশন থেকে মুক্তির জন্য কতটা মরিয়া সেই খবরটি অবধি পৌঁছে গেছে প্রতিপক্ষের শিবিরে? আর তাই যদি হয় তবে তো আরেক “আরব বসন্ত” ইরানে খুব সন্নিকটে- একেবারে দুয়ারে দাঁড়িয়ে। কথিত “আরব বসন্ত”র ঢেউতে ইরানের সাধারণ জনমানুষ জেগে উঠে,তবে এর পরিণতির ভালো-মন্দ দুই দৃষ্টান্ত মধ্যাপ্রাচ্যের “আরব্য রজনীর”দেশে দেশে বিরাজমান।

কথিত আরব বসন্তের নামে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতায় ভারসাম্য বিনষ্ট হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ। ইরান যদি নিজ দেশ ও ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা সঠিক ভাবে উপলব্ধি করে তবেই মঙ্গল। এধারায় ইরানকে নিজের আদর্শ নীতি যুগোপযোগী করে জনবান্ধব করার প্রয়োজন হবে। নিজ দেশের অভ্যন্তরে কট্টরপন্থা থেকে সরে এসে নারী শিশু ও ভিন্ন মতের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া জরুরি। ইরানের সাধারণ মানুষের সাফোকেশন থেকে মুক্তির পথে ইরানের বর্তমান শাসকেরা যতটা হিতাকাঙ্ক্ষী হবেন ততই মঙ্গল। একই ভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলেও পরিবর্তন আনা জরুরি! ফিলিস্তিনের ভাগ্য বদলের জন্যে যতটা এর চেয়ে বেশি নিজের এখতিয়ার বাড়াতে হামাস কিংবা হিজবুল্লাহর মদদ কতটা দেবেন এটাও নতুন করো ভাবতে হবে। ইরানের পুরানো বন্ধু ইজরায়েলের জন্য মুসলিম ভ্রাতৃত্বের প্রতি ইরানের মনোভাব নতুন করে গড়তে হবে। তবেই ইরানের প্রতি মুসলিম বিশ্বের ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই এমন ধারার ভাবমূর্তির পরিবর্তন সম্ভব হবে।

নচেৎ নিজ দেশের সাধারণ আমজনতার সমর্থনে সহসাই যদি “আরব বসন্ত”র সূচনা হয় তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর “আরব বসন্তের” নামে দেশে দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতার কাঠামো বদল যে, সাম্রাজ্যবাদে নয়া কৌশলের বাড়-বাড়ন্ত তা নিজ দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের আর সব রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক হবে না তা ইতিহাস সাক্ষী।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক, গবেষক।