‘কোথাও নিরাপত্তা নেই’, ইসরায়েলি হামলার মাঝে ইরানিদের জীবন
প্রকাশিতঃ 10:33 am | June 16, 2025

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, কালের আলো:
‘আটকে গেছি’—এই একটি শব্দেই ইরানে বর্তমানে জীবন কেমন, তা বোঝাচ্ছেন অধিকাংশ মানুষ। ইসরায়েলের তিন দিনব্যাপী টানা হামলার পর সবাই কোনো না কোনোভাবে তেহরান থেকে পালানোর চেষ্টা করছে, বিবিসি নিউজ পার্সিয়ানকে বলেছেন এক বাসিন্দা।
রোববার শহরজুড়ে পেট্রল পাম্পগুলোতে দীর্ঘ লাইন পড়ে। অনেকেই নিরাপদে থাকতে দূরবর্তী এলাকায় চলে যেতে চাইলেও তীব্র যানজটে তারা তেহরান প্রদেশের বাইরেই যেতে পারেননি।
‘তেহরান একেবারেই নিরাপদ নয়’, এমন মন্তব্য করে এক বাসিন্দা বলেন, “ইসরায়েলি হামলার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কোনো সাইরেন বা আগাম সতর্কতা দেওয়া হয় না। শুধু বিস্ফোরণের শব্দ শুনি আর আশা করি আমাদের বাসায় না লাগে। কিন্তু যাবই বা কোথায়? কোথাও নিরাপদ মনে হয় না। ”
তেহরান থেকে অন্য এক প্রদেশে যেতে পেরেছেন এমন একজন বলেন, “আমি এখনও পুরোপুরি বুঝেই উঠতে পারিনি যে, আমি একটি যুদ্ধক্ষেত্রে বাস করছি। জানি না কখন এই বাস্তবতা মেনে নিতে পারব। ”
তিনি আরও বলেন, “এটা আমার যুদ্ধ না। আমি কোনো পক্ষের সমর্থক নই। শুধু আমার পরিবারসহ বাঁচতে চাই। ”
শুক্রবার থেকে ইসরায়েল গত কয়েক বছরের সবচেয়ে বড় বিমান হামলা চালিয়েছে ইরানে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইরানও ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।
ইসরায়েলে কমপক্ষে ১০ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আর ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে দেশটির গণমাধ্যম জানিয়েছে, শনিবার দুপুর পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় ১২৮ জন নিহত হয়েছেন।
তেহরানের এক নারী বলেন, ‘গত দুই রাত ঘুমাতে পারিনি। ভয়ানক সময় কাটাচ্ছি। ’ এই পরিস্থিতি ১৯৮০-এর দশকের ইরান-ইরাক যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়—যখন তিনি শিশু ছিলেন এবং বোমাবর্ষণ থেকে বাঁচতে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতেন।
ওই নারী আরও বলেন, “তবে পার্থক্য হচ্ছে, তখন অন্তত বোমা পড়ার আগে সাইরেন বাজতো, আমরা প্রস্তুতি নিতে পারতাম। এখন কোনো সতর্কতা নেই—হঠাৎ করেই বোমা পড়ে। ”
বিবিসি নিউজ পার্সিয়ানের ঘনচে হাবিবিয়াজাদ জানান, যুদ্ধের পরে জন্ম নেওয়া তরুণ প্রজন্ম এসব অভিজ্ঞতার কিছুই জানে না।
শহর ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন তেহরানের আরেক নারী। তিনি বলেন, “আমরা সবাই ছোট শহর বা গ্রামের দিকে যেতে চাইছি। কিন্তু আমাদের অনেকেই এমন প্রিয়জনদের জন্য থাকতে বাধ্য হচ্ছি, যাদের শহর ছাড়ার সুযোগ নেই। তাদের কথা ভেবেই থেকে যাচ্ছি। আমরা যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা কোনোভাবেই ন্যায্য নয়। ভয়, ক্লান্তি আর মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছি—এটা খুবই কঠিন আর যন্ত্রণাদায়ক। ”
রাজধানীর আরেক বাসিন্দা বলেন, “আমি চাইলেও তেহরান ছাড়তে পারছি না। আমার বয়স্ক মা-বাবা আছেন, তারা দূরে কোথাও যেতে পারবেন না। আর অফিসেও আমাকে হাজিরা দিতে হয়। এখন আমি কী করব?”
দেশে ইন্টারনেটও অনেক সময় ঠিকমতো কাজ করছে না, ফলে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে। বিদেশে থাকা ইরানিরা তাদের প্রিয়জনদের খোঁজে বারবার বার্তা পাঠাচ্ছেন জবাব পাওয়ার আশায়।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কিছু ইরানিকে সতর্কবার্তা দিয়েছে, সেনাবাহিনীর ঘাঁটির আশপাশের এলাকা থেকে সরে যেতে। তেহরানে থাকা মানুষজন এসব বার্তা পেয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত।
আমরা কীভাবে বুঝব কোনটা সেনাঘাঁটি, আর কোনটা না?—বলেছেন এক ব্যক্তি।
হামলার দ্বিতীয় দিনে ইরানিদের উদ্দেশে এক বার্তায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, “এখন সময় এসেছে তোমাদের স্বাধীনতার পক্ষে এক হওয়ার। ”
তবে বিবিসি নিউজ পার্সিয়ানের দারিয়ুশ কারিমি জানান, ইরানের ভেতরে এখন পর্যন্ত মানুষ নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকেই গুরুত্ব দিচ্ছে এবং নেতানিয়াহুর এই আহ্বানে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
বিবিসির সাংবাদিক পুয়ান কালানি জানিয়েছেন, দেশের ভেতরে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা দিয়েছে আবাসিক ভবনগুলো ধ্বংস হওয়ার চিত্র, এমনকি পারমাণবিক স্থাপনা বা বিমানঘাঁটিতে হামলার চেয়েও বেশি। ইরানের অনেক নাগরিক এমন দৃশ্য এর আগে দেখেননি, বিশেষ করে রাজধানীর রাস্তায় এমন ধ্বংসযজ্ঞ।
তেহরানসহ অন্যান্য শহরের মানুষ এখনো শুক্রবারের বিভ্রান্তির কথা মনে করছেন, আসলে তখন কী ঘটছিল, কতটা বিস্তৃত ছিল হামলা, আর তারা নিজেদের ও পরিবারকে কীভাবে রক্ষা করবেন—এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই তারা ব্যস্ত।
বিবিসি পার্সিয়ান নিউজের প্রতিবেদন থেকে অনুবাদকৃত
কালের আলো/এএএন