উত্থান-পতন শেষে ঘুরে দাঁড়িয়েছে রিজার্ভ
প্রকাশিতঃ 9:41 am | May 22, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ২৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, আগামী মাসে অর্থাৎ, জুনে এই রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে ৩০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, যার জন্য সময় প্রয়োজন। এখন সবাইকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দিতে হবে। বুধবার (২১ মে) পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) আয়োজনে রাজধানীর গুলশানে হোটেল আমারিতে ‘বাংলাদেশে আর্থিক উন্নয়নের ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক প্রবণতা’ শীর্ষক গবেষণার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানান তিনি।
সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পরিবর্তনের পর রিজার্ভ বাড়তে শুরু করে। আবদুর রউফ তালুকদারের স্থানে দায়িত্ব নেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি দায়িত্ব নিয়েই কঠোর অবস্থান নেন রিজার্ভ পুনরুদ্ধারে। এর আগে রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রবাসীদের অনাগ্রহ, হুন্ডির দাপট ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপের মধ্যে গভীর সংকটে পড়ে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার পালিয়ে যান এবং পদত্যাগ করেন। ঠিক তখনই দায়িত্ব নেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। দায়িত্ব নিয়েই তিনি বাস্তবমুখী নীতির প্রয়োগ শুরু করেন। এর প্রভাবও দেখা যায় দ্রুতÑ২০২৪ সালের ৮ আগস্টের পর থেকে রিজার্ভে ধীরে ধীরে উন্নতি শুরু হয়। ২০২৪ সালের আগস্টে প্রবাসী আয় দাঁড়ায় ২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৯ শতাংশ বেশি। এর ফলেই সাময়িক ঊর্ধ্বগতি দেখা যায় রিজার্ভে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিজার্ভ বাড়ায় আমদানি ব্যয় পরিশোধে চাপ কমেছে এবং ব্যাংকগুলো সহজে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রিজার্ভ বৃদ্ধির এই সাফল্যের পেছনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনায় কৌশলগত সিদ্ধান্তের পাশাপাশি কাজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের কঠোর অবস্থান ও বাস্তবমুখী নীতি। সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ও আমদানি ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আসায় ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৫ থেকে ১২৮ টাকা হয়ে যাওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছিল। বর্তমানে ডলারের বিনিময় হার ১২৩ টাকায় স্থিতিশীল, এর ফলে আমদানি স্বাভাবিক ও মূল্যস্ফীতিও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অবশ্য এবারই প্রথম নয়, চলতি বছরেই এ নিয়ে দুবার ২৬ বিলিয়নের মাইলফলক ছুঁয়েছে রিজার্ভ। প্রথমবার ছিল গত ফেব্রুয়ারি মাসে। এর আগে ২০২১ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল সর্বোচ্চ, ৪৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার। এরপরে ধারাবাহিকভাবে পতন হয়ে ২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর সর্বনিম্ন ২৪ দশমিক ১৯ বিলিয়নে নেমে আসে। বিপিএম-৬ অনুযায়ী তা ছিল মাত্র ১৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মূলত বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ ও অভ্যন্তরীণ দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণেই রিজার্ভের এমন পতন ঘটে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সাল থেকে প্রতি মাসে গড়ে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার করে রিজার্ভ কমেছে। যদিও ২০২৪ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অন্তত দুবার ২৬ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। প্রথমবার ২৭ জুন আইএমএফের তৃতীয় কিস্তির ঋণ পাওয়ার পর রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। আর দ্বিতীয়বার ২৯ ডিসেম্বর, তখন রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার (বিপিএম ৬ অনুযায়ী ২১ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন)।
২০২৪ সালের ৩১ জুলাই আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সপ্তাহে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার, আর আইএমএফের মানদণ্ড অনুযায়ী ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। ৫ আগস্ট এক নাটকীয় রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে এবং ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। সরকার পরিবর্তনের দিন, অর্থাৎ ৮ আগস্ট রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার এবং বিপিএম ৬ অনুযায়ী ২০ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছর (২০২৫) সবশেষ রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, এই প্রবৃদ্ধির মূলে ছিল প্রবাসীদের আয়। ফেব্রুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স আসে ২ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। মার্চে রেমিট্যান্স রেকর্ড ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়ে রিজার্ভে বড় ভূমিকা রাখে। এছাড়া আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও হুন্ডি প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপও রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
কালের আলো/আরআই/এমকে