চৈত্র সংক্রান্তি ও মৎস্য উপদেষ্টাকে ব্যক্তিগত আক্রমণের নেপথ্যে
প্রকাশিতঃ 3:38 am | April 17, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
বাংলা বছরের শেষ দিন, অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। বছরের শেষ দিন হিসেবে পুরাতনকে বিদায় ও নতুন বর্ষকে বরণ করার জন্য প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে থাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন। আবহমান বাংলার চিরায়িত বিভিন্ন ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে এই চৈত্র সংক্রান্তি। চলতি বছর প্রথমবারের মতো চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ একত্রে উদযাপন করেছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার এক্ষেত্রে রীতিমতো এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই প্রসঙ্গেই গত রোববার (১৩ এপ্রিল) বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে দুইদিনব্যাপী চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখ উদযাপন অনুষ্ঠানে নারী ও চৈত্র সংক্রান্তি আলোচনায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বাঙালির অন্যতম বড় অসাম্প্রদায়িক এই উৎসব যে প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার শিক্ষা দেয় এমনটি উচ্চারণ করেছিলেন বেশ গুরুত্বের সঙ্গে।
সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘এই প্রথম বাংলাদেশে সরকারিভাবে চৈত্র সংক্রান্তি এবং পহেলা বৈশাখ একত্রে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যার ফলে দেশের সংস্কৃতিতে আমরা শুধু এতদিন পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে আসছিলাম তার একটি পরিবর্তন আসলো; কারণ এটাই আমাদের আসল সংস্কৃতি।’ কিন্তু মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতারের এই বক্তব্যকে ভিন্নখাতে প্রবাহের জোর অপতৎপরতা শুরু হয়েছে। উপদেষ্টাকে বিতর্কিত করতে ব্যক্তিগত আক্রমণ পর্যন্ত করা হচ্ছে। দুরভিসন্ধি থেকেই বিষয়টিকে ধর্মীয় মোড়ক দেওয়ার কসরত দৃশ্যমান হয়েছে।
অথচ উপদেষ্টা চৈত্রসংক্রান্তির এই কথাটি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছেন। তিনি কোনও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের দৃষ্টিকোণ থেকে এমনটি বলেননি। পাশাপাশি দেশের গ্রামাঞ্চলের মুসলমানরাও এটি অনুসরণ করে আসছেন আবহমানকাল থেকেই। কিন্তু কথার কৌশলে পুরো বিষয়টিকে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপনের মাধ্যমে সুযোগ সন্ধানীরা পরিকল্পিতভাবে তাকে ঘিরে বিদ্বেষ ছড়ানোর পাঁয়তারা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
জানা যায়, চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্যের যখন প্রচণ্ড উত্তাপ থাকে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও বৃষ্টি লাভের আশায় কৃষিজীবী সমাজ বহু অতীতে চৈত্র সংক্রান্তির উদ্ভাবন করেছিল। কথিত আছে চৈত্র সংক্রান্তিকে অনুসরণ করেই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের এত আয়োজন। তাই চৈত্র সংক্রান্তি হচ্ছে বাঙালির আরেক বড় উৎসব। নারী ও চৈত্র সংক্রান্তি আলোচনায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বিষমুক্ত শাক সবজি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘যা দরিদ্র মানুষের পুষ্টির অন্যতম উৎস। চৈত্র সংক্রান্তি পালন করতে গিয়ে শাকসবজি খুঁজতে যেন আমাদের বেগ পেতে না হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই উৎসবের দিন সাধারণত বিভিন্ন পদের শাকসবজি দিয়ে তরকারি তৈরি করার প্রচলন আছে। এদিন কোনো প্রকার আমিষ খাওয়া হয় না। গ্রাম বাংলার যতো ধরনের আয়োজন ও বৈচিত্র্য সংস্কৃতি তা এই চৈত্র সংক্রান্তিতে দেখা যায়।’ চৈত্র সংক্রান্তির ঐতিহ্যবাহী ১৪ রকমের শাকের কথা উল্লেখ করে ফরিদা আখতার বলেন, ‘এই শাক বর্তমানে আর বিশুদ্ধভাবে পাওয়া যায় না। আজকাল পরিবেশ দূষণের কারণে এবং নানা আধুনিক কৃষিতে কীটনাশক ও আগাছানাশক ব্যবহারের কারণে আমরা শাক পেলেও তা ব্যবহার উপযোগী নয়। কারণ সেটা বিষাক্ত হয়ে যায়। আমরা যদি পরিবেশটাকে বিষমুক্ত করতে পারি তাহলে শাকগুলোকে আমরা সবাই খেতে পারবো।’
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যের পুরোটাজুড়েই চৈত্র সংক্রান্তিতে প্রকৃতি রক্ষার জ্ঞান ও কৃষির ভুল সংশোধনের চর্চাকেই প্রকারান্তরে মুখ্য করে তুলেছেন। প্রকৃতিকে সদা সর্বদা নতুন রাখাই সবার কর্তব্য এটিও তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কোন ধরনের গাছ-গাছালি বা কোন জাত বা প্রজাতির অভাব ঘটছে, কৃষক নারী সেটা বুঝতে পারেন চৈত্র সংক্রান্তিতে। প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ চৌদ্দ রকমের শাক কুড়িয়ে এনে খাওয়া গ্রামীণ নারীর জ্ঞান ও স্বরূপকেও তিনি মোটা দাগে উদ্ভাসিত করেছেন। কিন্তু অনেকেই বুঝে না বুঝে কারণে-অকারণে অহেতুক বিতর্ক তৈরির মাধ্যমে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। যদিও ওই চক্রটির জ্ঞান পাপী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় হালে পানি পাচ্ছেন না মোটেও।
দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এবং তাঁর স্বামী কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহারকে নিয়ে অপতথ্যের তাণ্ডব চালানো হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পূর্ণ মূল্য দিচ্ছেন। অতীতের যা কিছু স্বৈরতন্ত্রের ত্রাসে চাপা পড়েছিল এবং ফ্যাসিবাদের তাণ্ডবে রক্তাক্ত হয়েছিল, সেসব তথ্য ও সত্য ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে। কিন্তু এই সুযোগে ক্ষেত্র বিশেষে আবার প্রতিহিংসাও চরিতার্থ হচ্ছে। অবাধে ছড়ানো হচ্ছে ভুল বা অপতথ্য। গুজবকে সত্য বা তথ্য হিসেবে উপস্থাপন করছে মতলববাজ গোষ্ঠী। উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার ও তার স্বামী ফরহাদ মজহারকে নিয়ে চরম বিভ্রান্তিকর, বিপদজনক ও ক্ষতিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। যা প্রতিনিয়ত তাদের সম্মানহানি করছে। এটিকে তথ্য ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও চরম বাড়াবাড়ি বলছেন বিশ্লেষকরা। তবে তারা এসব মিথ্যাচারকে পাত্তা না দিয়ে ঘৃণাভরেই প্রত্যাখ্যান করেছেন।
কালের আলো/আরআই/এমকে