নিউইয়র্ক টাইমস’র বিষদৃষ্টি, নারীদের বিস্ময়কর অগ্রগতি ও ধর্মীয় উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে অটল সরকার

প্রকাশিতঃ 6:36 am | April 03, 2025

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর :

গত বছর যশোরের জামিয়া ইসলামীয়া মাদরাসার একটি ভিডিও নিয়ে রীতিমতো অপপ্রচার শুরু হয়। ভিডিওটিতে দেখা যায়, এক ব্যক্তি কাপড় দিয়ে চেহারা ঢেকে আরবি ভাষায় বক্তব্য দিচ্ছেন এবং তার দুই পাশে অস্ত্র সদৃশ বস্তু নিয়ে মুখ ঢেকে আরো দুজন কালো পোশাকে দাঁড়িয়ে আছেন। ওই ভিডিওটি প্রচার করে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে এবং জিহাদের ডাক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থেই ভিডিওটি ছিল সেই মাদরাসার বার্ষিক প্রতিযোগিতায় ছাত্রদের পারফরম্যান্সের। তবে সেই ভিডিওটি দেখিয়েই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ, সমাবেশ বা জিহাদের আহ্বান হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে এ বিষয়টি উঠে আসে। একইভাবে চলতি বছরের মার্চ মাসে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ২৯৮টি ভুল তথ্য শনাক্ত করে বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন গুজব ছড়ানো নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাত হলেই বাড়ছে গুজবের শঙ্কা। গত কয়েক মাস ধরে বেশি গুজব ছড়াচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের নানান ইস্যুতে। ‘ডাহা মিথ্যার’ অপতথ্যের জোয়ারে এবার গা ভাসিয়েছে মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস। তাঁরা বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের উত্থানের আশঙ্কা তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। মুজিব মাশাল ও সাইফ হাসনাতের করা প্রতিবেদনটির প্রতিবাদ করেছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশ সময় গত সোমবার (৩১ মার্চ) রাতে পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং মঙ্গলবার (১ এপ্রিল) এই প্রতিবেদনকে বিভ্রান্তিকর বলে উল্লেখ করে। সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্টসের ফেসবুক পেজে বলা হয়, ভুল চিত্র ও একতরফা দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে।

শুধু তাই নয় নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদনে দাবি করেছে, বাংলাদেশে মৌলবাদীরা নারী ফুটবল বন্ধ করে দিয়েছে, বাংলাদেশে নারীদের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান ঘটছে ইত্যাদি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এসব তথ্য মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এই অপপ্রচারের মূল উদ্দেশ্য অন্তর্বর্তী সরকারকে বিতর্কিত করা। গত ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর এই অপতথ্য-সংস্কৃতি প্রবল শক্তিশালী হয়ে ওঠেছে। এমন ছড়ানো অপতথ্য দিনকে যেন রাত, সত্যকে মিথ্যা এবং নিশ্চিতকে অনিশ্চিত করে দিচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমসও গুজব সৃষ্টিকারীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েছে। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে ঈদের ছুটিকেই বেছে নিয়েছে। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূসও গুজবকে অবহেলা না করার পরামর্শ দিয়েছেন। গুজব দেখলেই গুজবের সূত্রের সন্ধান করতে বলেছেন। ঈদুল ফিতর সামনে রেখে গত মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজবের ‘মহোৎসবের’ জন্য জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ‘পলাতক অপশক্তিকে’ দায়ী করে সামগ্রিক ঐক্য দিয়ে সব ষড়যন্ত্র রুখে দিতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘গুজব’ হলো এই জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পরাজিত শক্তির মস্ত বড় হাতিয়ার। তাই গুজবকে অবহেলা করবেন না।’

ধর্মীয় সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও নিউইয়র্ক টাইমস’র বিভ্রান্তিবিলাস
বাংলাদেশ কখনও ধর্মীয় মৌলবাদীদের দেশ নয়। এখানকার মানুষ বরাবরই ধর্মভীরু এবং একইসঙ্গে উদার। অন্যের ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এখানে মাগরিবের আজানের সময় হিন্দুদের শঙ্খ বাজে। এ নিয়ে এই ভূখণ্ডে কোনো দাঙ্গা হয়নি। বরং যেসব সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে আছে ভোটের রাজনীতি। কিছু ঘটনার পেছনে আছে জায়গা-জমি নিয়ে বিরোধ ও ব্যক্তিগত শত্রুতা। ধর্মীয় সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে একই উঠানে শতবর্ষী মসজিদ ও মন্দির রয়েছে দেশের কোথাও কোথাও। প্রতিদিন ভোরে ফজরের সময় মোয়াজ্জিমের কণ্ঠে মিষ্টি আজান শেষে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করে চলে যাওয়ার পরে পাশেই মন্দিরে শোনা যায় উলু ধ্বনি! এসবই প্রমাণ করে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আবহমানকাল থেকে বাংলা ভূখণ্ডে নানা জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মমতের অনুসারীরা পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে মিলেমিশে একত্রে বসবাসের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য সংহত রেখেছে। এদেশ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি। আমাদের এ দেশ অর্জিত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবার মিলিত রক্তস্রোতের বিনিময়ে।

কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমস’র প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে হয়রানির বিষয়টিকে ধর্মীয় উগ্রবাদের সঙ্গে জড়ানোর কারসাজি করা হয়েছে। যদিও এটি একটি ব্যক্তিগত অপরাধ। এর সঙ্গে ন্যূনতম ধর্মীয় কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আর পুলিশও ইতোমধ্যেই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে। নিউইয়র্ক টাইমসর বিভ্রান্তির অপকৌশলে এই ঘটনাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে, যা সত্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। মার্কিন গণমাধ্যমটি আরও দাবি করেছে, ‘বাংলাদেশে ইসলাম অবমাননার শাস্তি না দিলে মৌলবাদীরা নিজেরাই বিচার করবে।’ অথচ একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, ‘২০১৩ সালে একটি ইসলামি দল হাইকোর্টে ধর্ম অবমাননার শাস্তি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে রিট করে, যা আদালত খারিজ করে দেয়। বর্তমানেও অন্তর্বর্তী সরকার এই ধরনের কোনো দাবি গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশে আইনের শাসন সুসংহত এবং কোনো গোষ্ঠী আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে বিচার করতে পারবে না। এক্ষেত্রে সরকার অত্যন্ত কঠোর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ বেড়েছে। কিন্তু তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাশ কাটিয়ে গেছে। বাংলাদেশ সরকার হিজবুত তাহরীরের মতো সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে। গত এক বছরে ২০০ জনের বেশি উগ্রপন্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উগ্রবাদ দমনে সরকার শুন্য সহিষ্ণুতার নীতি গ্রহণ করেছে। এখানে উগ্রবাদের উত্থানের কোন সুযোগ নেই। হিজবুত তাহরীরের যে মিছিলের কথা বলা হচ্ছে, তা পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর যৌথ প্রযোজনায় একটি অপচেষ্টা, যা বর্তমান সরকার রুখে দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, উগ্রবাদী হিন্দু সংগঠন ইসকনের অপতৎপরতা ও নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরীরের সাম্প্রতিক ‘মার্চ ফর খিলাফত’ মিছিলটি একই সূত্রে গাঁথা। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ প্রেসক্রিপশনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির কুমতলবে আন্দোলনের নামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে পুনর্বাসনে তোড়জোড় শুরু করে ইসকন। কিন্তু সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পরিস্থিতি মোকাবিলায় অত্যন্ত ধৈর্যশীলতার পরিচয় দেয়। তাদের বিচক্ষণতায় সব কূটকৌশল ভেস্তে যায়। এরপর হিজবুত তাহরীর ইসকন’র মতোন একই রঙের ব্যানার ব্যবহার করে দুই থেকে তিন হাজার ভাড়াটিয়া নিয়ে মিছিল করতে চাইলে সরকার কঠোর হস্তে দমন করে। এসব ঘটনাপ্রবাহ থেকেই স্পষ্ট ধর্মীয় কোন উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে অন্তর্বর্তী সরকার প্রশ্রয় দেয়নি। রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করেছে। ধর্মীয় মৌলবাদসহ সব ধরনের উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে অটল অনমনীয়তা দেখিয়েছে তাঁরা। সম্ভবত নিউইয়র্ক টাইমস ভুলে গেছে- সম্প্রতি তাদের দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় বর্তমান সরকার এর ভূমিকার প্রশংসা করেছে। এটি প্রমাণ করে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি স্থিতিশীল।

বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ সব ধরনের উগ্রতার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেওয়া যে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে সরকার। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত হয়েছে। সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি, বন্ধন ও ভালোবাসায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক দর্শনও প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমস লেখক দাবি করেছেন, নতুন সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সরিয়ে বহুত্ববাদ আনা হচ্ছে। এখানেও বিষয়টিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং বহুত্ববাদ নিয়ে আলোচনা করেছে, তবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিলের কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি। বহুত্ববাদ একটি সামাজিক ধারণা, যা বিভিন্ন ধর্ম, মতাদর্শ ও সংস্কৃতির সহাবস্থান নিশ্চিত করে, কিন্তু এটি ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীত নয়। বরং ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি এটি রাষ্ট্রীয় নীতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। অতএব, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে—এমন তথ্য অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক। এছাড়া সকল সংস্কারের সিদ্ধান্ত সকল দলের সঙ্গে ঐক্যমতের ভিত্তিতেই গ্রহণ করা হবে।

মার্কিন গণমাধ্যমটিতে অভিযোগ করা হয়েছে- বাংলাদেশ আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো উগ্রবাদী হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে স্থিতিশীল দেশগুলোর একটি। তাহলে বাংলাদেশ আফগানিস্তানের মতো কীভাবে? বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভারত-পাকিস্তানের মতো নয়। ভারতে উগ্রবাদীদের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিশ্বব্যাপী সমালোচিত। বিপরীতে বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের দেশ। বাংলাদেশে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের পর অনেকেই মনে করেছিলেন যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন হবে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার, সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষসহ ধর্মীয় নেতারা ও মাদরাসার ছাত্ররা একত্রে হিন্দু মন্দির এবং হিন্দু সম্পত্তি রক্ষা করেছেন। এটি এক বিশাল সংহতির উদাহরণ। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে ধর্মীয় উগ্রবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, সহনশীলতা ও সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ এই দেশে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে শকুনের মতো থাবা বিস্তারের হীন অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে বিদেশি অপশক্তিরা।

নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উন্নয়নের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে সমান তালে
বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতি বিস্ময়কর। ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে, পারিবারিক শাসন-বারণের পাহাড় ডিঙিয়ে নারীরা অদম্য শক্তিতে বেরিয়ে এসেছেন। স্বাধীনতা-পূর্ব সেই প্রান্তিক-অক্ষম-অবলা-অশিক্ষিত-পরনির্ভরশীল-লাজুক ও অন্ধকারে ডুবে থাকা, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তকমা ছুড়ে ফেলে অনেকাংশেই নারী নিজেকে মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। আপনশক্তিতে বলীয়ান নারী নিজে ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে নিজেকে নতুনভাবে নির্মাণ করেছেন, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। কবি নজরুল লিখেছিলেন- ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

বাংলাদেশ নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে সমান তালে, সমান গতিতে। দেশের তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের নানামুখী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ, বাস্তবায়নকাজ চলছে। বদলে গেছে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। এখন নারীর কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বীকৃতি। প্রশাসন, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, বিচার বিভাগসহ সর্বস্তরে নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীরা দক্ষতা প্রমাণ করছেন, কৃতিত্ব দেখাচ্ছেন, নেতৃত্বও দিচ্ছেন। নারী অধিকার ও ক্ষমতায়নে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে তো বটেই, উন্নত অনেক দেশ থেকেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।

নারী-পুরুষের সমতা (জেন্ডার ইক্যুইটি) প্রতিষ্ঠায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষে বাংলাদেশ। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের লিঙ্গ সমতা সূচকে ৭৩তম অবস্থানে রয়েছে দেশ। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস তৈরি পোশাক খাতের যে ৪০ লাখের অধিক শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে তার ৮০ শতাংশের বেশি হলো নারী। এই শিল্পে কর্মসংস্থানের ফলে নারীরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করছে এবং নিজেদের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ পাচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকের অনুপাত সরকারি ক্ষেত্রে ৬৪.৪১ শতাংশ এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে ৬৬.০৩ শতাংশ। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে নারীশিক্ষার প্রসার বড় ভূমিকা রেখেছে। স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ৭০ শতাংশই নারী। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে নারী-পুরুষের সমতার দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশের ওপরে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। চারটি ক্ষেত্রে আবার বাংলাদেশ বিশ্বের সব দেশের ওপরে স্থান পেয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের নারী উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করছে। ক্রিকেট ও ফুটবলেও উজ্জ্বল বাংলাদেশের নারীরা।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশে নারীদের স্বাধীনতা না কী সংকুচিত হচ্ছে! কী আজব ব্যাপার! তারা বলছে, বাংলাদেশে মৌলবাদীরা নারী ফুটবল বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- এই বছরের ২৯ জানুয়ারি জয়পুরহাটে ফুটবল টুর্নামেন্ট’র আয়োজন করা হয়। আয়োজক কমিটি বিনা টিকেটে ফুটবল আয়োজনের অনুমতি নিলেও শর্ত ভঙ্গ করে টিনের বেড়া দিয়ে টিকিটের ব্যবস্থা করে। এতে করে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে মিডিয়ায় ভুলভাবে তথ্য ছড়ানো হয়৷ সেদিনের ম্যাচটি বাতিল হলেও ৫ ফেব্রুয়ারি হাজারো দর্শকের উপস্থিতিতে প্রীতি ম্যাচটি ঠিকই অনুষ্ঠিত হয়।

দেশের নারী ফুটবলের অর্জনের তালিকাটা দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে। বয়সভিত্তিক ফুটবলে বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা যে অপ্রতিরোধ্য সেটি বারবার প্রমাণিত। ফলে বাংলাদেশের নারী ফুটবল মানেই যেন হয়ে ওঠেছে ঝুলিভরা অর্জন। ২০২২ সালে বাংলাদেশ প্রথম সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জিতেছিল। তারা আবারও গত বছর মর্যাদাপূর্ণ সাফ শিরোপা ধরে রেখেছে এবং অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বাংলার বাঘিনীদের এমন জয়জয়কার বিশ্ব দরবারে উড়িয়েছে লাল-সবুজের বিজয় নিশান। অসীম বিক্রমে বজায় রেখেছে মাতৃভূমির সম্মান। কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমস বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদনের মাধ্যমে এসব বাস্তবতাকে অস্বীকার করে জ্ঞান পাপীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

আমরা এর আগেও দেখেছি বাংলাদেশকে ধর্মীয় উগ্রবাদী রাষ্ট্র প্রমাণের চেষ্টা হয়েছে। এটা প্রমাণ করা গেলে এখানে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাক গলানো সহজ হবে। আবার প্রতিবেশী দেশও যদি বিশ্বকে এই বার্তা দিতে পারে যে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি নতুন ধরনের সরকার গঠিত হলেও দেশটা মূলত কট্টরপন্থিদের হাতে চলে গেছে—তাহলে এই সরকারকে বিতর্কিত ও বিব্রত করা সহজ। কে কার স্বার্থে কাজ করছেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্বভাবতই নিউইয়র্ক টাইমস বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদীরা মাথাচাড়া দিয়েছে এমন অপপ্রচারের মাধ্যমে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার কৌশল আঁটছে। তারাও ঝোপ বুঝে কোপ মারার চেষ্টা করেছে। কিন্তু দেশের মানুষ তাদের এই অপপ্রচার প্রত্যাখ্যান করেছে। বুধবার (২ এপ্রিল) স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের মতো কিছুই হয়নি।’ বাংলাদেশে উগ্রবাদের কোনো উত্থান ঘটেনি বলে মনে করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেছেন, ‘পরাজিত শক্তি নিউইয়র্ক টাইমসে মিথ্যা তথ্য দিয়ে রিপোর্ট করিয়েছে। ফ্যাসিবাদের দোসররা হাজার হাজার কোটি অবৈধ টাকার মালিক। তাদের অবৈধ টাকা ব্যবহার করে বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে।’

কালের আলো/এমএএএমকে