চাপ বাড়ছে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে

প্রকাশিতঃ 10:45 pm | October 23, 2024

মো.শামসুল আলম খান, কালের আলো:

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণে চাপ বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা চলছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকার ম্যাগাজিনে তাকে উদ্ধৃত করে প্রকাশিত বক্তব্য ঘিরে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শপথ ভাঙার অভিযোগ এনেছে খোদ অন্তর্বর্তী সরকার। তবে বিতর্ক থামেনি। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ইনকিলাব মঞ্চ, রক্তিম জুলাই, ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র-জনতার মঞ্চসহ তাদের সমমনা বেশ কয়েকটি সংগঠন এই দাবিতে সোচ্চার রয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধানকে অপসারণের আলটিমেটামও দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

তাঁর পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বুধবার (২৩ অক্টোবর) টানা দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। তবে শেখ হাসিনার পদত্যাগের হার্ডকপির বিষয়ে আদতে রাষ্ট্রপতি কী বলেছেন এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। বঙ্গভবন সূত্র নিশ্চিত করেছে, রাষ্ট্রপতি কোনো গণমাধ্যমকে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার দেননি। আর অনানুষ্ঠানিকভাবেও তিনি বলেছেন, ‘শি হ্যাজ রিজাইনড, শি হ্যাজ রিজাইনড, শি হ্যাজ রিজাইনড।’ মীমাংসিত বিষয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরি না করতে আহ্বানও জানিয়েছিল তাঁর কার্যালয়। এরপরেও তাঁর পদচ্যুতির দাবির পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে কি-না সেটিও এখন আলোচনায় ঠাঁই করে নিয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে, শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে রাষ্ট্রপতির নামে যে বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ল, সেটি কি আনুষ্ঠানিক কোনো সাক্ষাৎকার ছিল? না, আনুষ্ঠানিক কোনো সাক্ষাৎকার রাষ্ট্রপতি দেননি বলে বঙ্গভবন সূত্র বিভিন্ন গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে। আর মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি মীমাংসিত বলে জানিয়ে দেন। এরপরও এই ইস্যুতে এত আলোচনা-বিতর্ক থেমে নেই।

এদিকে রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে দেশে এ মুহূর্তে সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হোক, সেটা বিএনপির কাছে কাম্য নয়। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বুধবার (২৩ অক্টোবর) গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি পদটা একটা সাংবিধানিক পদ বা একটা প্রতিষ্ঠান- সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ। এই পদে হঠাৎ করে পদত্যাগের মাধ্যমেই শূন্যতা সৃষ্টি হলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে, রাষ্ট্রীয় সংকট সৃষ্টি হবে।’

‘রাষ্ট্রীয় সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে যদি গণতন্ত্রে উত্তরণের পথটা বিলম্বিত হয়, বাধাগ্রস্ত হয় বা কণ্টকাকীর্ণ হয়- এটি জাতির কাম্য নয়। সুতরাং পতিত ফ্যাসিবাদ এবং তাদের দোসররা যাতে কোনও ষড়যন্ত্র না করতে পারে, এখানে অন্য কিছুর পাঁয়তারা না করতে পারে সেজন্য আমরা সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানাচ্ছি এবং আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবেই এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করবো।’

রাজনৈতিক ময়দান যখন এ বিষয়ে উত্তাল ঠিক সেই মুহুর্তে বিএনপির জ্যেষ্ঠ তিন নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহ উদ্দিন আহমদ বুধবার (২৩ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাদের দেখা করার বিষয়টি তাই ঔৎসুক্য তৈরি করে। যদিও নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, দেশে যাতে নতুন করে সাংবিধানিক সংকট না সৃষ্টি হয়, সে জন্য তাঁরা খেয়াল রাখতে বলেছেন।

এদিকে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন যদি পদচ্যুত হন সেক্ষেত্রে কে বসবেন ওই পদে, এ নিয়ে নানা গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছে। ইতোমধ্যেই প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছেন। মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সরকারের প্রভাবশালী দু’উপদেষ্টা ড.আসিফ নজরুল ও নাহিদ ইসলাম তাঁর সঙ্গে রুদ্ধদ্ধার বৈঠকে প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সূত্র জানায়, প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে চলা সেই বৈঠকে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ রাষ্ট্রপতি নন, এই মুহূর্তে নিজের দায়িত্বই পালনের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। বুধবার (২৩ অক্টোবর) সকালে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে কোন কথা বলতে রাজি হননি আইন উপদেষ্টা। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোনো কথা বলব না। এখন অনেক ব্যস্ত আছি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা বলছেন, সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে চলবে কি না দেশ অথবা নতুন কোনো পথ খোঁজা হবে তা দ্রুত পরিস্কার করা উচিৎ। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, এ বিষয়টা স্পষ্ট করা দরকার। যদি কনস্টিটিউশনের ভেতরে থাকতে চায় তাহলে কনস্টিটিউশন মেকানিজম নিয়ে চলবে। আর যদি এর বাইরে যেতে চায় তাহলে বর্তমান কনস্টিটিউশন কি হবে এটাও তাদেরকে বলতে হবে। তবেই এটা স্পষ্ট হবে, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, চলে যাওয়া না যাওয়া। নতুবা অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান কি কিংবা তা মেকানিজমে আছে কিনা সবকিছু স্পষ্ট করে দেয়া দরকার।

সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করবেন স্পিকারের কাছে। যেহেতু স্পিকার পদত্যাগ করে এখন শুন্য, ডেপুটি স্পিকার ফানশান করতে পারছেন না, তিনি কারাগারে আছেন বলে আমরা জেনেছি। সুতরাং সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে আমার মতামত হচ্ছে যদি কোনো সময় রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে চান তিনি নিজে নিজে পদত্যাগ করবেন। এ পদত্যাগটা কাউকে এড্রেস করে করতে হবে এটা নেসেসারি না।

কবি মহাদেব সাহা বলেছিলেন, হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো সংবিধান নেই, তবে বাংলাদেশে সেই সংবিধান একাধিকবার কাঁটা ছেড়া করে সংবিধানের হৃদয়কেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। এরই মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিটি করা হয়েছে। হয়তো সংবিধান নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত আসবে আবারও।

এদিকে, বুধবার (২৩ অক্টোবর) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘বাহাত্তরের মুজিববাদী সংবিধান বাতিল এবং রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণ দাবিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক’ শীর্ষক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ গত ৩ আগস্ট আমাদের এক দফায় ছিল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল একাত্মতা পোষণ করে রাজপথে নেমে আসে। হাসিনার পতনে আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জন হয়েছে। ’৭২-এর সংবিধানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছে, ফ্যাসিস্ট সংঘবদ্ধ হয়েছে, এর প্রসারণ হয়েছে। যখন হাসিনা সরকারকে পদত্যাগের কথা বলা হতো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচনের কথা বলা হতো—তারা সবসময় সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার দোহাই দিতো। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সংবিধানের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে টিকিয়ে রাখতে চায়।

তিনি আরও বলেন, তাদের কাছে আহ্বান থাকবে ’৭২-এর সংবিধান প্রশ্নে এবং আমাদের অভ্যুত্থান প্রশ্নে আপনাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। কারণ যারা গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে, এক দফায় একাত্মতা পোষণ করেছে তারা ’৭২-এর সংবিধান সমর্থন করতে পারে না। ৫ আগস্টের ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ ঘোষণার অন্যতম হচ্ছে ’৭২-এর মুজিববাদী সংবিধান বিলোপ করতে হবে। একাত্তর পরবর্তী সংবিধান আওয়ামী সংবিধান, বাকশালী সংবিধান। মুজিববাদী আদর্শের আড়ালে বাংলাদেশ পরিচালিত হতো। চব্বিশের অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে বাকশালী সংবিধান অপ্রাসঙ্গিক।

জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, আজকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মিটিং ছিল। আমরা দেখেছি সেখানে হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের যে অংশগুলো রয়েছে সেগুলো তারা এখনও রাখা বা বাস্তবায়নের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা বিএনপির বিবৃতিতে দেখেছি যে তারা বলেছে, সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হবে এবং রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হবে। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি স্পষ্ট করে বলতে চাই, চুপ্পুকে (রাষ্ট্রপতি) যদি অপসারণ না করা হয় তাহলেই সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হবে।

রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন চুপ্পুর পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরতদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিরাজমান পরিস্থিতিতে যত রাজনৈতিক দল আছে, তবে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, জাতীয় পার্টিসহ অপ্রাসঙ্গিক দলগুলো বাদে যে দলগুলো প্রাসঙ্গিক, গণঅভ্যুত্থানে যেসব শক্তিটা রয়েছে তাদের প্রতি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিচ্ছি।

কালের আলো/এমএসএকে/এমএএএমকে