ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে
প্রকাশিতঃ 8:40 pm | October 18, 2024

মো.শামসুল আলম খান, কালের আলো:
দ্রুত সময়ের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবিতে সোচ্চার রয়েছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি।নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন করে অবিলম্বে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে দলটি। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিলেও দিন-মাস পরিস্কার না হওয়ায় নানান কথাবার্তা উচ্চকিত হতে থাকে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এর পর এবার সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ আইন উপদেষ্টা ড.আসিফ নজরুল আগামী বছরের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজনের কথা জানিয়েছেন। তবে এর আগে নতুন নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদ করবে বলেও জানান তিনি। আইন উপদেষ্টার এমন ভাষ্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতিবাচক আলোচনা চলছে। ধোঁয়াশা কেটেছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও। গত বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) মধ্যরাতে চ্যানেল আইয়ের ‘আজকের পত্রিকা’ অনুষ্ঠানে দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী নির্বাচন কবে হতে পারে-এমন প্রশ্নের জবাবে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড.আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, আগামী বছরের মধ্যে নির্বাচন করাটা হয়তো সম্ভব হতে পারে। অনেক ফ্যাক্টর রয়েছে। এটা প্রাইমারি অ্যাজাম্পসন (প্রাথমিক অনুমান)।’
‘আমার কাছে মনে হয়, আগামী বছরের মধ্যে নির্বাচন করাটা হয়তো সম্ভব হতে পারে। অনেক ফ্যাক্টর রয়েছে। এটা প্রাইমারি অ্যাজাম্পসন (প্রাথমিক অনুমান)।’
ড.আসিফ নজরুল
উপদেষ্টা
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়
জানা যায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর শান্তিতে নোবেল জয়ী ড.মুহাম্মদ ইউনূসের ৮ আগস্ট নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কার ও মেরামতে বিভিন্ন কমিশন কর্মতৎপরতা শুরু করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংস্কারের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরার মত পরিস্থিতি হলেই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। প্রধান উপদেষ্টা প্রায় তিন দফা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। প্রতিটি আলোচনার পাশাপাশি নিজেদের বিভিন্ন কর্মসূচিতেও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। প্রধান উপদেষ্টাও নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ বলেই প্রতিবারই নিজের মত দিয়েছেন। তবে নির্বাচনের সম্ভাব্য মাস-কালের কথা বলা না হওয়ায় স্বভাবতই প্রশ্ন ছিল বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে। যদিও দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর নির্বাচনের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করে।
ড.ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য কামনা করে, প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দেড় বছরের মধ্যে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে গত মাসে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সংস্কারের মধ্য দিয়ে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্রে উত্তরণ’ ঘটা উচিত। তবে সেজন্য সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।’ সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যের পর দেশের রাজনৈতিক মহলে স্বস্তি ফিরে আসে। প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই তাঁর বক্তব্যকে স্বাগত জানায়।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার, নতুন কমিশন গঠন, ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি এক বছরের মধ্যেই সম্পন্ন করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কখন হবে এটা আমার জানার কথা নয়। আমার ধারণা, সরকার ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারিত হবে। তবে নির্বাচন কমিশন সংস্কারে আমাদের ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দল ও সরকারের মধ্যে সংলাপ হবে। নির্বাচনী ব্যবস্থার সব দিক নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করব এবং এর ভিত্তিতে সুপারিশ প্রণয়ন করব। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম বলেন, নির্বাচন নিয়ে আইনি কাঠামো যা আছে, সেগুলো সংস্কার করা খুব জরুরি। অর্থাৎ পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়া রিভিউ করতে হবে। শুধু নির্বাচনের আগে নয়, ভোটের পরও নির্বাচনী বিরোধগুলো বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, সেগুলো নানা সংকটে সমাধান হয় না, সেসব বিষয়ও এই পর্যালোচনায় উঠে আসতে পারে। এগুলো দ্রুত করা সম্ভব। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, সংস্কারে সংবিধানের বিষয়টি থাকবে মৌলিক। সংবিধান সংস্কার করা হলে তার ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচন-প্রক্রিয়ার অন্য কাজগুলো শুরু করতে হবে।
২০২৫ সালে সংসদ নির্বাচন নিয়ে যেসব কথা বলেছেন আইন উপদেষ্টা
চ্যানেল আইয়ের সংবাদ পর্যালোচনামূলক অনুষ্ঠান ‘আজকের সংবাদ’-এ দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ‘কিছুদিনের মধ্যেই’ সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেবে। নতুন নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে আগামী বছরের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে।
তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, রিয়েস্টিক্যালি আগামী বছরের মধ্যে (২০২৫) ইলেকশন করাটা হয়ত সম্ভব হতে পারে।’ প্রসঙ্গত, গত ৫ সেপ্টেম্বর বিদায় নিয়েছে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন, যাদের অধীনে চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিদ্যমান ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ’ আইন, ২০২২ অনুযায়ী শূন্য পদে নিয়োগ দিতে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি করার বিধান রয়েছে। সবশেষ নির্বাচন কমিশনই এ আইনের অধীনে প্রথম নিয়োগ পেয়েছিল।
৫ অগাস্টের পর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষপদে পদত্যাগের হিড়িকের পর সাংবিধানিক পদসহ নানা স্তরে শূন্যপদ পূরণ হচ্ছে ক্রমশ। গত বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) মধ্যরাতে চ্যানেল আইয়ের ওই অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘কয়েকটা ধাপ রয়েছে। যেমন ধরেন, আমরা যখন নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করলাম, তখন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। নিশ্চয় ভুয়া নির্বাচন কমিশন থেকে নির্বাচন হোক তা কখনোই চান না।’
‘নতুন নির্বাচন কমিশন করার জন্য একটা সার্চ কমিটি করা লাগবে। সার্চ কমিটি গঠন করতে গিয়ে দেখলাম, সার্চ কমিটিতে পিএসসির চেয়ারম্যান লাগবে। পিএসসির চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হল। পিএসসির চেয়ারম্যান নিয়োগও তো একটা পদ্ধতি। এখন এ সার্চ কমিটি গঠিত হবে। এরপর নির্বাচন কমিশন হবে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠন হওয়ার পর প্রথম কাজই হবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা।’ এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন-‘ভোটার তালিকার নামে ২০২৪ এর নির্বাচনে অরাজকতা করেছিল। ২০২৪ সালে ভোটার তালিকার নামে কী করেছে তা নিয়ে অনুসন্ধান করা দরকার।’
সঠিক ভোটার তালিকা তৈরির ওপর জোর দিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, ‘এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে সার্চ কমিটি হচ্ছে। এখন ভোটার তালিকা নির্বাচন কমিশন ছাড়া কেউ আদেশ দিতে পারে না। ইসির আদেশে তা হবে, এটা ইসির কাজ। ধাপগুলো চিন্তা করতে হবে। সার্চ কমিটি করলাম; তারপর নির্বাচন কমিশন হবে। এরপর ভোটার তালিকা হবে। তারপর নির্বাচন হবে।’
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এর আগে বলেছিলেন, ১৮ মাসের মধ্যে দেশে নির্বাচন হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। সেক্ষেত্রে কতদিনের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে, সেই প্রশ্ন আইন উপদেষ্টার সামনে রাখা হয়। জবাবে তিনি বলেন, ‘সেনাপ্রধান কেন বলেছেন আমি জানি না। তবে আমার কাছে মনে হয়, বাস্তবিকভাবে আগামী বছরের মধ্যে ইলেকশন করাটা হয়ত সম্ভব হতে পারে।’ তাহলে ২০২৫ সালেই কি নির্বাচন হতে পারে? এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, ‘ হ্যাঁ। আরও অনেকগুলো ফ্যাক্টর তো রয়েছে। অনেক ধরনের ফ্যাক্টর রয়েছে; এটা আমার প্রিলিমিনারি অ্যাজাম্পশন।’
ওই অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, দ্রব্যমূল্য নিয়েও কথা বলেন আসিফ নজরুল। তিনি সবচেয়ে ক্ষমতাধর উপদেষ্টা-এমন ধারণার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আসিফ নজরুল বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ ভুল প্রচার এবং উপদেষ্টা পরিষদের অন্য উপদেষ্টাদের মতো তাঁরও একই সমান ক্ষমতা।’ তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্র নেতাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি আলোচনা করেন এবং এটি যৌক্তিকভাবে সম্পন্ন হয়।’
কালের আলো/এমএসএকে/এমএএএমকে