‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ জীবন উৎসর্গ করে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন’
প্রকাশিতঃ 12:22 pm | December 17, 2022

কালের আলো প্রতিবেদক:
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) রাঙামাটি সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তরিকুল ইসলাম বলেছেন, মুন্সী আব্দুর রউফের অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ পদক্ষেপের ফলে শত্রুবাহিনী মহালছড়িতে মুক্তিবাহিনীর মূল অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। তিনি তার জীবন উৎসর্গ করে কর্তব্যপরায়ণতা ও দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
শুক্রবার (১৬ ডিসেম্বর) সকালে রাঙামাটির নানিয়ারচরের বুড়িঘাটে অবস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিজিবি রাঙামাটি সেক্টরের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
শ্রদ্ধা নিদেবন শেষে রাঙামাটি সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের একজন মুন্সী আব্দুর রউফ। তিনি নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাটে শুয়ে আছেন। দেশকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্যের সঙ্গে ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফও ছুটে আসেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। এই বুড়িঘাটের চৌকিতে ন্যস্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মকে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের বীরত্বগাথা এই অর্জন সবার মাঝে তুলে ধরতে হবে। পর্যটকরা এখানে ভ্রমণে আসলে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেস। পাশাপাশি রাঙামাটির প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারবেন।’
প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন মুন্সী আব্দুর রউফ। এই জলপথ দিয়ে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর চলাচল প্রতিরোধের দায়িত্ব পড়ে তার কোম্পানির ওপর। কোম্পানিটি বুড়িঘাট এলাকার চেঙ্গিখালের দুই পাড়ে অবস্থান নিয়ে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলে।

৮ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য মর্টার, মেশিনগান ও রাইফেল নিয়ে বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ধ্বংস করতে সাতটি স্পিডবোট এবং দুটি লঞ্চ নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। এটি ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের (এসএসজি) কোম্পানি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছেই পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। স্পিডবোট থেকে মেশিনগানের গুলি এবং আর লঞ্চ দুটি থেকে তিন ইঞ্চি মর্টারের শেল নিক্ষেপ করছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে। পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিলো রাঙামাটি-মহালছড়ির জলপথ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা।
বীর মুক্তিযোদ্ধারাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পরিখায় অবস্থান নিয়ে নেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর গোলাগুলির তীব্রতায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে যায়। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করে ফেলে। যুদ্ধের এই পর্যায়ে আব্দুর রউফ বুঝতে পারেন এভাবে চলতে থাকলে ঘাঁটির সবাই প্রাণ হারাবেন। তখন কৌশলগত কারণে পশ্চাৎপসরণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এই সিদ্ধান্ত সৈন্যদের জানানো হলে সৈন্যরা পিছু হটতে শুরু করেন।
এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী তখন খুব কাছে চলে আসে। ফলে একযোগে পিছু হটতে থাকলে একসঙ্গে সবাই মৃত্যুবরণ করতে হতে পারে ভেবে আব্দুর রউফ পিছু হটেননি। সহযোদ্ধাদের পিছু হটার সুযোগ করে দিতে নিজে পরিখায় দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি স্পিডবোটগুলোকে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকেন তিনি। পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে একা কৌশলে লড়ছিলেন। তিনি তাদের সাতটি স্পিডবোট একে একে ডুবিয়ে দিলে তারা তাদের দুটি লঞ্চ নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
লঞ্চ দুটো পিছু হটে রউফের মেশিনগানের গুলির আওতার বাইরে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী এরপর লঞ্চ থেকে মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। মর্টারের গোলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রউফের একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবু তিনি চেষ্টা চালিয়ে যান। হঠাৎ একটি মর্টারের গোলা তার বাঙ্কারে এসে পড়ে এবং তিনি শহীদ হন। কিন্তু তার মৃত্যুর আগে সহযোগী যোদ্ধারা সবাই নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন। সেদিন আব্দুর রউফের আত্মত্যাগে তার কোম্পানির প্রায় ১৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রাণে বেঁচে যান।
কালের আলো/এসবি/এমএম