সেনাপ্রধানের হীরকদ্যুতিতে জ্বলজ্বল মুক্তিযুদ্ধ, দিনমান কর্মযজ্ঞ শৈশব ‘স্মৃতি জাগানিয়া’ নড়াইলে

প্রকাশিতঃ 10:18 pm | January 04, 2022

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর :

রাজা-জমিদারদের তীর্থ ভূমি নড়াইলে কেটেছে সেনাপ্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের দুরন্ত উচ্ছ্বাসে ভরপুর শৈশব। ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’, আত্নসমর্পণে বাধ্য পাকবাহিনীকে ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা শেখ রোকন উদ্দিন আহমেদ। জাতির একজন সূর্য সন্তানের আত্নজ হিসেবেই স্বচোখে তিনিও দেখেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্ত-অশ্রু।

সেই রুদ্ধশ্বাস সমরের দিনলিপি গভীরভাবে আন্দোলিত করেছিল তাঁর শিশুমনকেও। হৃদয়ের মনিকোঠরে দাগকাটা সেই সময়ে তাঁর বয়স ৭ কী ৮ বছর। তখন মহাবিজয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকন্ঠের আহ্বানে তাঁর বাবার মতোই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা অসামান্য শৌর্য আর বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে হটিয়েছিলেন পাকিদের।

জেনেছেন নিশ্চিত মৃত্যু; কিন্তু দ্বিধার একটি পলকও ফেলেননি ওইসব চোখ। শৈশবের সোনার খাঁচায় খসে যাওয়া দিনগুলো আজও যেন মনে পড়ে সেনাপ্রধানের। জ্বলজ্বল করে মনের হীরকদ্যুতিতে! পরম সম্পদ মেনে এই দিনগুলোর স্মৃতিকেই যেন জীবনভর আগলে রেখেছেন। অত:পর মঙ্গলবার (০৪ জানুয়ারি) ছুটে গেছেন নিজের পৈতৃক ভিটা নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার করফা গ্রামে।

কেবল-ই কী তাই? নিভৃত মানবিকতার মুক্তদানার বিচ্ছুরণে জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন দাঁড়িয়েছেন নড়াইলের গরিব ও অসহায় মানুষের পাশেও। স্থানীয় মল্লিকপুর করফা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে প্রায় দু’হাজার মানুষের হাতে তিনি তুলে দিয়েছেন দেশপ্রেমী বাহিনীর ভালোবাসার শীতবস্ত্র।

প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শীতকালীন প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দেশজুড়ে অসহায় ও দু:স্থ মানুষের শরীরে জড়িয়ে দিচ্ছে উষ্ণতার উপহার। ত্রাণ আর চিকিৎসা সেবাসহ নানামুখী জনকল্যাণমুখী কর্মযজ্ঞে সম্পৃক্ত রেখেছেন নিজেদের, উদ্ভাসিত করেছেন কালজয়ী চেহারায়।

প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে চলা শীতার্ত মানুষ দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর এমন অনির্বাণ মানবিকতায় খুশি। এবার তাদের পরম মমতার পরশে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসেই অনিন্দ্য সুন্দর একটি দিন পার করেছেন শীতের সঙ্কটে বেদনাবৃত্তে নিমজ্জিত নড়াইলের অসহায় মানুষেরাও।

অতীতের কাছে জমা রেখে আসা নিজের সোনালী শৈশবের সঙ্গে নিবিড়ভাবে অঙ্কিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের নড়াইল অধ্যায়। জীবনের পূর্ণতার এই সময়ে অতীত স্মৃতি হৃদয়ে উঁকি দেয়া মাত্রই যেন ভালো লাগারই এক মুগ্ধতা ছড়ায়।

শাশ্বত আত্মার অন্তর্নিহিত মর্মরধ্বনিতে চির মাধুর্যের সুরে সতত বহমান তাঁর শৈশব জীবনের নড়াইলের গল্পগাঁথা। নিজের জবানীতে তুলে আনলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বহ্নিশিখাকে। স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের এক প্রশ্নের উত্তরে অতীতের হীরন্ময় প্রকোষ্ঠে হারিয়ে গিয়ে জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলতে থাকলেন- ‘নড়াইল আমার জন্মভিটা নয়, আমার জন্ম খুলনায়; আমি বড় হয়েছি খুলনায়। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি নড়াইলে ছিলাম। কারণ এটা হলো আমার বাপ-দাদার জন্মস্থান।’

সততা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গেই সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথরেখায় দীর্ঘ ৩৮ বছরের বর্ণাঢ্য সামরিক জীবনে তাঁর শ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়া। নড়াইলের স্মৃতির গ্রামেও সম্ভবত মঙ্গলবার (০৪ জানুয়ারি) তিনি খুঁজে ফিরেছেন সেই ধূলোমাখা পথচিহ্ন আর স্মৃতির সরণি। স্মৃতি-সত্ত্বা-ভবিষ্যতকে সঙ্গী করেই এগিয়ে গেছেন জীবনের অনিবার্যপথে, যেখানে সাফল্যে রাঙিয়েছেন নিজেকে।

হয়তো এদিন নিজের গ্রামে চোখে পড়েনি সেই পুরনো কাঠামো বা বিন্যাস। গ্রামীণ জীবনের পাশাপাশি ল্যান্ডস্কেপও হয়েছে পরিবর্তিত। বদলেছে জীবনের সীমা-পরিসীমা। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় নিজের স্মৃতির গ্রামের সুন্দর প্রতিচ্ছবিই যেন ভেসে উঠলো সেনাপ্রধানের দু’নয়নজুড়ে।

অযুত নিযুত পালাবদল সত্ত্বেও শৈশবের উজ্জ্বল দিনগুলো নিয়ে তাঁর স্মৃতিচিত্র মলিন হয়নি মোটেও। শান-শওকতে ভরা জমিদার বাড়ির আবছায়া আর নেই। কালের গর্ভে অনেক কিছুই হয়েছে বিলীন। হারিয়েছে নিজের বাপ-দাদা’র বাড়ির প্রাচীন ইমরাত বা সাংস্কৃতিক দ্যোতনা।

মানুষগুলোও চলে গেছেন জীবনের চেয়ে বহুদূরের ঠিকানায়। আবেগমথিত কন্ঠেই তাই সেনাপ্রধানের উচ্চারণ-‘এই নড়াইলে আমাদের বাড়ি ছিল। এখানে একটি বড় জমিদারবাড়ি ছিল আমাদের। সেই বাড়িটি দেখলাম এখন অনেকটাই ভেঙে গেছে নদী ভাঙনে। কিন্তু এখানে এসে একটি আলাদা অনুভূতি কাজ করছে আমার ভেতর। স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা, অনেক স্মৃতিই আজ মনে পড়ছে।’

সেনাবাহিনীতে প্রথমবারের মতো লজিস্টিক এফটিএক্স অনুশীলন
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে প্রশিক্ষণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন সেনাপ্রধান। প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মান বিশ্ব পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ারও দৃঢ় অঙ্গীকার করে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে ৫০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আর্মি লেভেল লজিস্টিক এফটিক্স (ফিল্ড ট্রেনিং এক্সারসাইজ) পরিচালিত হচ্ছে।’

জেনারেল শফিউদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন শীতকালীন প্রশিক্ষণে সারাদেশে মোতায়েন রয়েছে। আমরা যখন প্রশিক্ষণে জনগনের কাছে যাই তখন আমরা এই সুযোগটা গ্রহণ করি; তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। এই প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে আমরা আজকে এখানে শীতবস্ত্র বিতরণ করছি।

শুধু এখানেই নয়, আমরা বাংলাদেশের সব জায়গায়, যেখানেই সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণের জন্য মোতায়েন করেছি সেখানেই শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের কিছু কম্বল বা অন্যান্য সাহায্য দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা কম্বল বিতরণের বাইরেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী বিতরণ এবং চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছি।’

প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে যুগোপযোগী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমাদের মাননীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যুগোপযোগী এক বাহিনী হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বে শান্তিরক্ষায় সেনা প্রেরণকারী দেশ হিসেবেও শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ সেনবাহিনী।

পেশাদারিত্বের কারণেই আমরা এটি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও যাতে আমরা আরও সুনাম ছড়িয়ে দিতে পারি এজন্য প্রশিক্ষণকেই মূল ফোকাস রেখেছি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার সক্ষমতার জায়গায় পৌঁছতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।’

আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, এর আগে সেনাপ্রধান লোহাগড়ায় এসে পৌঁছালে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়ক মেজর জেনারেল এফ এম জাহিদ হোসেন ও ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং যশোরের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মো. নূরুল অনোয়ার তাকে অভ্যর্থনা জানান।

মধুমতি নদীর উপর নির্মিতব্য রেল সেতু পরিদর্শন
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ পরে মধুমতি নদীর উপর নির্মিতব্য রেল সেতু প্রজেক্ট ও মধুমতি আর্মি ক্যাম্প পরির্দশন করেন। এ সময় পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়ক এবং ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি উপস্থিত ছিলেন।

আইএসপিআর জানিয়েছে, দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোর সাথে রাজধানী ঢাকার রেল সড়ক সংযুক্তি বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম সংযুক্তি প্রকল্প। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ১৭২ কিলোমিটার রেল পথের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় নয়টি জেলা রাজধানী ঢাকার সাথে সরাসরি সংযুক্ত হবে। এই রেলপথ ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, যশোর এবং খুলনা জেলাকে রেলপথ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করবে।

প্রকল্পটি ২০১৮ সালে জুলাই মাসে শুরু হয় এবং ২০২৪ সালের জুলাই মধ্যে সমাপ্ত হবে। প্রকল্প সমাপ্তির পর জাতীয় অর্থনীতিতে আনুমানিক ১.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটবে বলে আশা করা যায়। সরকারের জি টু জি প্রকল্পের আওতায় চীনের এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়নে রেল মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্পে ‘চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী’ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কর্মরত রয়েছে।

প্রকল্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রকল্প সুপারভিশন এবং পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করছে। এই প্রকল্পে ১৭২ কিলোমিটার রেলপথে মোট ৫৯ টি রেল সেতু, ১২৪ টি কালভার্ট ও ১৩২ টি আন্ডারপাসসহ মোট ২০ টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। বর্তমানে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৪৫.৭৮ শতাংশ।

কালের আলো/এমএএএমকে