বিজ্ঞান চর্চার সংস্কৃতি গড়ে তোলা জরুরি

প্রকাশিতঃ 1:00 pm | September 09, 2021

শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া:

পরাধীন জাতির বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে না। বাঙালি দীর্ঘকাল পরাধীন থেকেছে। সে সময় সাধারণ মানুষের খেয়েপরে বেঁচে থাকাই কঠিন ছিল। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার সুযোগ এবং সাধ্য কোনোটাই তখন তাদের ছিল না। পরাধীনতার শেষ শতকে অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন ঘটলেও জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা আমাদের পূর্বপুরুষদের সূদুরপরাহতই থেকে যায়। ব্রিটিশ আমল বলি আর পাকিস্তান আমল বলি, উভয় শাসনামলেই এদেশের মানুষের শিক্ষা অমার্জনীয় অবহেলার শিকার হয়। প্রজা অধিক শিক্ষিত হলে রাজার জন্য তা ভয়ের কারণ হয়- এ আপ্তবাক্য বিদেশি শাসকদের না বোঝার কথা নয়। ফলে সাধারণ শিক্ষা লাভই যেখানে দুর্লভ ছিল, সেখানে বিজ্ঞান শিক্ষা যে আঁতুড়ঘরেই ছিল তা সহজেই অনুমান করা চলে। অনেকে অবশ্য স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, ড. কুদরাত-এ-খোদা, ড. শাহ্‌ মো. হাসানুজ্জামানের মতো দুই-চারজন বিজ্ঞানীর নাম উল্লেখ করতে পারেন। তবে ব্যতিক্রম উদাহরণ হিসেবে না নেওয়াই সমীচীন। তাছাড়া বিজ্ঞান শিক্ষা, বিজ্ঞান চর্চা আর বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও এর প্রসার সাধনের কাজ এদেশে খুব একটা হয়নি। তদুপরি হাতেনাতে শিক্ষার যে বিজ্ঞান, সে বিজ্ঞান এদেশে বরাবর অধরাই ছিল। ফলে সতেরো শতাব্দী থেকে একে একে তিনটি বিজ্ঞানভিত্তিক শিল্পবিপ্লব চলে গেছে আমাদের কোনো মনোযোগ আকর্ষণ এবং অংশগ্রহণ ছাড়াই। পাকিস্তান আমলে এসে আমাদের যে বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু হয়েছিল, সেটিও ছিল মূলত তাত্ত্বিক বিজ্ঞান চর্চা। বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য আলাদা অবকাঠামো তৈরি, যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক বস্তুসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা এবং জীবনঘনিষ্ঠ ও প্রায়োগিক বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সাধারণ বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের বরাবরই নাগালের বাইরে ছিল। ফলে এদেশে বিজ্ঞান চর্চার সংস্কৃতিই গড়ে ওঠেনি কখনও।

বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে বিজ্ঞান গবেষণার বিষয়টি বরাবরই অন্বিষ্ট হয়ে থাকার কথা। তাত্ত্বিক বিজ্ঞান কেবলই অসার হয়ে যায়, যদি এর প্রয়োগ না ঘটে। মানুষের সভ্যতা যে দিনে দিনে এগিয়েছে তার কারণ তাত্ত্বিক বিজ্ঞানকে প্রয়োগিক কাজে লাগিয়ে মানুষের কর্মের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছিল। শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান মানুষের দৈনন্দিন জীবনে আরও অধিক প্রয়োগমুখী হয়েছে এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কারণ ঘটিয়েছে। এসব সম্ভব হয়েছে সিরিয়াস বিজ্ঞান পঠন-পাঠন, লক্ষ্যভিত্তিক গবেষণা ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তি উদ্ভাবন, সেগুলোর ব্যবহার ও প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে। আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষা, বিজ্ঞান চর্চা, গবেষণা এবং গবেষণার ফলে প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে তা জনকল্যাণে প্রয়োগ করার উদাহরণ বড় কম। বিজ্ঞানের বহু ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব উদ্ভাবিত প্রযুক্তি নেই বললেই চলে। প্রায়োগিক বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের অংশগ্রহণ খুবই অপ্রতুল বলেই এমনটি হয়েছে। বাস্তবে বিজ্ঞান চর্চার মতো এদেশে সত্যিকার অর্থে গবেষণার কালচারও গড়ে ওঠেনি। তা গড়ে ওঠেনি গবেষণার ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন পৃষ্ঠপোষকতা না দেওয়ার কারণে।

আমাদের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বিজ্ঞান পঠন-পাঠনের ক্ষেত্র বেশ প্রসারিত হলেও বিজ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞানমনস্কতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখনও আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। তাছাড়া শিল্প উৎপাদনের জন্য বিদেশি প্রযুক্তি আমদানি ও এসবের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তির উন্মেষ ঘটাতে দেয়নি। কোনো বিজ্ঞানী কোনো প্রযুক্তি উদ্ভাবন করলেও যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা না থাকার কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। পাশাপাশি বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণা অব্যাহত রাখার জন্য যে অবকাঠামোগত, যান্ত্রিক এবং রাসায়নিক ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করাসহ ধারাবাহিক আর্থিক সংশ্নেষের প্রয়োজন ছিল, তা অব্যাহত রাখা হয়নি। স্বাধীনতা-পরবর্তী তিন-চার দশক পর্যন্ত এদেশে গবেষণার সুযোগও বেশ সীমিতই ছিল। ধার করা প্রযুক্তি এবং বিদেশ থেকে আমদানি করা যন্ত্রপাতিনির্ভর আমাদের শিল্পের সঙ্গে গবেষক/বিজ্ঞানীদের মেলবন্ধনই গড়ে ওঠেনি। ফলে শিল্পকারখানায় বিজ্ঞান গ্র্যাজুয়েটরা চাকরি করছে বটে, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ বড় সীমিত থেকেছে। এ কারণে বিজ্ঞানী গবেষকদের সঙ্গে আমাদের শিল্পের পরস্পর নির্ভরতার সম্পর্ক যেমন গড়ে ওঠেনি, তেমনি গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আমরা পিছিয়ে পড়েছি।

গত এক দশক ধরে এদেশে গবেষণার অর্থায়ন সহজলভ্য হয়েছে সরকারের গবেষণা সহায়ক নীতি ও অর্থায়ন করার কৌশলের কারণে। অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় এ সময়কালে গবেষকরা অধিকতর সুযোগ লাভ করেছেন। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানের সফল প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে আমরা বেশিদূর এগোতে পারিনি। আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে অবহেলার শুরু স্কুল থেকেই। এ থেকে উত্তরণে প্রয়োজন বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ, দক্ষ বিজ্ঞান শিক্ষক নিয়োগ এবং নিয়মিত তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যখন চলছে আর পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের যাত্রা যখন শুরু হয়েছে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে, আমরা তখনও অধিকাংশ স্কুল-কলেজে প্রায়োগিক বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারিনি। বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণা খাতে আরও বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে পারলে এবং গবেষকদের গবেষণায় উৎসাহী করতে পারলে ধীরে ধীরে বিজ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞান গবেষণার কালচার গড়ে উঠবে। তবে দুই-দশ বছরেই তা করা সম্ভব হবে তা হয়তো নয়। এ বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে।
এদেশের কৃষিতে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ফলে বীজশিল্প এখন বিকাশমান রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সহায়তায় নতুন নতুন প্রযুক্তি কৃষির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল বয়ে এনেছে। বিজ্ঞানের অন্য ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবনও কিছু রয়েছে বটে, তবে আরও বহু শাখায় প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে ভীষণ রকম পিছিয়ে রয়েছি আমরা। প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য প্রায়োগিক বিজ্ঞানের ব্যবহার নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। দেশে বিজ্ঞান চর্চা আর গবেষণা কালচার গড়ে তোলার মাধ্যমেই কেবল তা সম্ভব হতে পারে।

আমাদের সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার সুযোগ বেশ বেড়েছে। নানা রকম উৎস থেকে অর্থায়িত গবেষণা প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে গবেষণার সুযোগ এখন অনেকটাই হাতের নাগালের মধ্যে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গবেষণার জন্য প্রকল্পভিত্তিক অর্থায়নের সুযোগ বেড়েছে। তবে কেবল অর্থায়নই গবেষণার একমাত্র নিয়ামক শক্তি তা কিন্তু নয়। গবেষকদের লক্ষ্যভিত্তিক গবেষণা পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত জ্ঞান যেমন থাকতে হবে তেমনি অন্য গবেষকদের সঙ্গে জ্ঞান বিনিময়ের জন্য যৌথভাবে গবেষণা পরিচালনার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। গবেষককে তার পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরাল গবেষণার আবর্তে কেবল ঘুরপাক খেলেই চলবে না, দেশের প্রয়োজনকে মাথায় নিয়ে গবেষণার লক্ষ্য স্থির করতে হবে। তদুপরি, বিভিন্ন উৎস থেকে একাধিক গবেষণা প্রকল্প অর্জনই বড় কথা নয়, সফলতার জন্য ধারাবাহিক এবং লক্ষ্যভিত্তিক গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন ছাড়া আগামী দিনের উন্নয়নের সঙ্গে তাল মেলাবার কোনো উপায়ই থাকবে না। স্থিতিশীল উন্নয়নের জন্য প্রকৃত অর্থে এর কোনো বিকল্পও নেই। দেরি অনেক হয়ে গেছে বটে, তবু এখন অন্তত বিজ্ঞান ও গবেষণার গুরুত্বের কথা কেবল অনুধাবন করা নয় বরং জোরেশোরে বাস্তবেই কর্মে লেগে যাওয়া উচিত।

উপাচার্য, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়