শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা এবং করোনারোধে করণীয়

প্রকাশিতঃ 10:44 am | September 07, 2021

রাজন ভট্টাচার্য :

করোনা মহামারির দ্বিতীয় ধাক্কা অনেকটাই সামলে উঠেছে বাংলাদেশ। সবার আন্তরিক সহযোগিতায় অন্য দেশের তুলনায় কম মৃত্যুর মধ্যে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যে নতুন আলোচনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুদের সমস্যার শেষ নেই। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সামাজিক অপরাধ ও বাল্যবিবাহ।

ঝরে পড়া শিশুদের একটি বড় অংশকে যে কোন মূল্যে স্কুলে ফেরাতে হবে। এজন্য সরকারের আলাদা নজর দেয়া প্রয়োজন। যদি এই অংশের পুরোটাই স্কুলের বাইরে থেকে যায় তবে ভবিষ্যত বাংলাদেশের জন্য এটি বড় রকমের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতে, করোনা সংক্রমণের হার ১০ ভাগের নিচে এলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলা যায়। এজন্য দীর্ঘ সময় সরকারকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। কোভিড নিম্নমুখী অবস্থার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর ঘোষণা আসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। ঘোষণার ঠিক পরদিন আরেকটি ভালো খবর হলো তিন মাস পর মহামারি করোনা সংক্রমণের হার ১০ ভাগের নিচে নেমেছে। এই পরিস্থিতিতে পুলিকিত হওয়ার সুযোগ নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো ক্লাস চালু হচ্ছে। এ সুযোগে দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ যেন মহামারি আকারে চোখ রাঙাতে না পারে। এজন্য সরকার, অভিভাবকসহ শিক্ষকদের দায় অনেক। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই সামনের দিনগুলোতে মসৃণ পথচলার কথা ভাবতে হবে।

বিশ্বের অনেক দেশে স্কুল চালুর পর কিন্তু করোনা বেড়েছে। তারপর আবারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হয়েছে। অবহেলার কারণে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও ব্যাহত হয়েছে সাধারণ মানুষের। তাই আমাদের কোনো অবস্থায়ই বিষয়টিকে অবহেলার চোখে দেখলে চলবে না। সপ্তাহে ক্লাস যে ক’দিন হোক, করোনা প্রতিরোধে সবচেয়ে জরুরি সচেতনতা। মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি।

দুই.
করোনা সংক্রমণ নিম্নমুখী হওয়ায় দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধের পর ১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ঘোষণা এসেছে। গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি শুরু হয়। সরকারের সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছুটি। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে ছুটি আর বাড়ছে না।

গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে বৈঠক করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পক্ষে মত দেয় করোনাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। এরই ধারাবাহিকতায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই খুলছে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও।

জাতিসংঘ শিশু তহবিল বা ইউনিসেফের ২৪ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ এর কারণে স্কুল বন্ধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম দেশ। দীর্ঘ বন্ধের ফলে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এদিকে গত শনিবার শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল জানান, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর চলতি মাসেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলেও শুরুতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস সপ্তাহে একদিনের সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।

তিন.
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর মধ্য দিয়ে অনেক দিন পর শিশুরা আলোর মুখ দেখবে। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে। তাই নিজেদের মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে। এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য তো রয়েছেই। স্কুলে গিয়ে পছন্দমতো আসনে বসা, কলম-খাতা আর কালির আনুষ্ঠানিক ব্যবহার, শিক্ষকদের নজরদারি, পড়ানো, টিফিনে ছুটে চলা সব মিলিয়ে বাড়তি উৎসাহের শেষ নেই। কিন্তু এরকম পরিবেশ সবার জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এজন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর পর করোনা প্রতিরোধে সরকারি নির্দেশনা শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

সবার আগে জরুরি স্কুলের ভেতরে বহিরাগত প্রবেশ বন্ধ করা। সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার বিকল্প নেই। মাস্ক ছাড়া শিশু, শিক্ষকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না। তিন ফুট দূরত্বে বাসার ব্যবস্থা করা, সামাজিক সব রকমের দূরত্ব মেনে চলা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র, জীবাণুনাশক ট্যানেল স্থাপন করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। তবে স্কুলের বারান্দা বা গেটে স্যানিটাইজার মেশিনও বসানো যেতে পারে।

সর্বোপরি শিশুদের অবাধ মেলামেশা বন্ধ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে শিক্ষকদের কঠোর হতে হলে অভিভাবকদের তা মেনে নিতে হবে। অভিভাবকদেরও এ বিষয়গুলো সন্তানদের বুঝিয়ে স্কুলে পাঠানো দরকার। অর্থাৎ করোনা সংক্রমণ রোধে শিক্ষক ও অভিভবকদের দায় সমান। স্কুল চলাকালীন শিক্ষার্থীদের বাইরে বের হওয়া বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে স্কুল বেগে বাড়ি থেকে টিফিন বক্সে খাবার ও পানি দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো। এ কাজগুলো যদি যথাযথভাবে পালন সম্ভব না হয়, তবে কিন্তু করোনা বসে থাকবে না। আবারো মাথা তুলে দাঁড়াবে। সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়বে। এবার শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ বাড়লে কিন্তু পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। পরিস্থিতি সামাল দেয়া না গেলে সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপও বৃদ্ধি পাবে। তাই আগে থেকেই সংশ্লিষ্ট সব মহলকেই সর্বোচ্চ সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।

চার.
দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুদের মানসিক ও শারীরিক যেমন বিরূপ প্রভাব পড়েছে তেমনি অনেক শিশু বিপথে গেছে। আবার শ্রমজীবীসহ ঝরেপড়া শিশুর সংখ্যা নেহাত কম হবে না। তাই এসব শিশুকে স্কুলমুখী করতে হবে। শিশুদের একটি অংশ সমাজের বখে যাওয়াদের সঙ্গে মিশে নেশাগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি গ্যাংগিং কালচারে অনেকে নাম লিখিয়েছে।

টাকার লোভ আর তারুণ্যের কারণে সামাজিক নানা অপরাধের সঙ্গে তারা নিজেদের যুক্ত করেছে। এতে বাড়তি উৎসাহ জুগিয়েছে এনড্রয়েট মোবাইল ফোন। আরেকটি অংশ পরিবারের চাকা সচল রাখতে শ্রমিকের খাতায় নাম লিখিয়েছে। নামমাত্র বেতনে যোগ দিয়েছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। এমনও বাস্তবতা আছে, ছেলেশিশুদের থেকে মেয়েশিশুরা বেশি বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ সুযোগে সমাজের একশ্রেণির অভিভাবক দায় ঘোচাতে কন্যাশিশুদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছেন। অল্প বয়সে এসব মেয়ে শিশুরা মাও হয়েছে, যা সমাজের জন্য ভালো কোনো উদাহরণ হতে পারে না।

সব মিলিয়ে ঝরেপড়া শিশুদের একটি বড় অংশকে যে কোনো মূল্যে স্কুলে ফেরাতে হবে। এজন্য সরকারের আলাদা নজর দেয়া প্রয়োজন। যদি এ অংশের পুরোটাই স্কুলের বাইরে থেকে যায় তবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য এটি বড় রকমের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক ।