লাঘব মানবিক সঙ্কট; খাবার সহায়তার আওতায় পল্লীর ফ্রন্টলাইন ফাইটাররা!

প্রকাশিতঃ 6:00 pm | May 10, 2020

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

সামান্য পারিশ্রমিকেই ছুটেন দেশের কাজে, সরকারের নির্দেশে। সেজন্যই তৃণমুলের বাসিন্দাদের সাথেই গড়ে উঠেছে নিবিড় যোগাযোগ! সাধারণ মানুষকে সুরক্ষায় গ্রামে গ্রামে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কঠোর অনুশাসনের দিকেই তীক্ষ্ন দৃষ্টি দিয়েছেন।

সকাল বা রাত বলে কোন কথা নেই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঈে ‘গাঁটছড়া’ বেঁধেই নিরবিচ্ছিন্নভাবে ছুটেছেন দেশের বেশিরভাগ পল্লীর বাড়ি বাড়ি। সাদাসিধে ভাষায় যুক্তি-বুদ্ধির সম্মিলনে বুঝিয়েছেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে।

কোয়ারেন্টাইন বা সঙ্গনিরোধের ‘মাজেজা’ মানতে করেছেন উৎসাহিত-উজ্জীবিত। আপদে-বিপদে সার্বক্ষণিক সহযোগিতার মনোভাব নিয়েই থেকেছেন প্রান্তিক মানুষজনের পাশাপাশি।

সাধারণ মানুষজনের মাঝে ‘সচেতনতার বার্তা’ পৌঁছে বেমালুম নিজেরাই কীনা ভুলেছেন নিজেদের অভাব-দারিদ্র্যতাকে! আবার এ নিয়েও নেই কোন আক্ষেপ বা হ্যাপিত্যেশ!

যদিও হাসিমুখে কষ্ট আড়ালের এই প্রবণতা ঠিক সময়েই অনুধাবন করেছেন আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (ভিডিপি) হাইকমান্ড।

কারণ করোনাভাইরাস সংক্রমণে সবার মতো চরম বিপাকে পড়েছেন নিজেরাও। ফলশ্রুতিতে নিজ বাহিনীর স্বেচ্ছাসেবী সদস্যদের চরম মানবিক সঙ্কটে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নিজেদের বাহিনী।

করোনায় ‘বিপর্যস্ত’ সময়ে নিজেদের গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ১ লাখ ৫৫ হাজার সদস্যকে সরাসরি খাবার সহায়তার আওতায় আনা হয়েছে। সময়োপযোগী কার্যকর এই উদ্যোগে আদতে উপকারভোগী হবেন কমপক্ষে ৫ লাখ জনগোষ্ঠী।

দেশের ৬৪ জেলার প্রতি উপজেলায় ৩০০ পরিবার হিসেবে ৪৯২ উপজেলায় মোট এক লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ পরিবার এবং ঢাকা মহানগরের ২০ থানায় ৭ হাজার পরিবারের মধ্যে এক সপ্তাহের খাবার বিতরণের বৃহৎ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে জোরেশোরেই।

গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতি সদস্যকে দেওয়া হচ্ছে পাঁচ কেজি চাল, দুই কেজি আলু, এক কেজি ডাল, এক লিটার তেল, এক কেজি পেঁয়াজ, একটি সাবান ও একটি মাস্ক।

নিজ বাহিনীর তৃণমূলের সদস্যদের জন্য ‘মানবিক’ এই উদ্যোগ গ্রহণ করে তাদের আন্দোলিত করেছেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল কাজী শরীফ কায়কোবাদ।

নিজের এই উদ্যোগের নেপথ্য কারণ জানিয়ে বাহিনীটির প্রধান কাজী শরীফ কায়কোবাদ কালের আলোকে বলেন, ‘করোনায় মহামারি ঠেকাতে শুরু থেকেই অন্যান্য বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে গ্রামে গ্রামে নিরলসভাবে কাজ করছেন ভিডিপির সদস্যরা।’

তিনি বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়েই গ্রামে গ্রামে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদেরও কঠিন সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই পথ চলতে হয়।

বাহিনী এবং দায়িত্বের প্রতি গর্বিত সদস্যদের শতভাগ নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং পরিশ্রম বিবেচনা করেই সঙ্কটময় সময়ে তাদের জন্যও মানবিক সহায়তা জরুরি হয়ে পড়ে।

আর এই বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করেই নিজেদের ওপর দায়িত্বে আরও মনোযোগী এবং প্রাণিত করতেই ভিডিপির ১ লাখ ৫৫ হাজার সদস্যকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।’

জানা যায়, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী দেশের যে কোন সঙ্কটে-দুর্যোগে নিজেদের নিবেদিতপ্রাণ ভূমিকায় উপস্থাপন করেছেন। নির্বাচনে শৃঙ্খলা রক্ষাতেও প্রথমেই ডাক পড়ে তাদেরই।

পুলিশের সঙ্গে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্বও পালনের পর করোনা সংক্রমণ রোধেও কী রাজধানী বা দেশের প্রত্যন্ত পল্লীতেও সমানতালেই সক্রিয় তারা। করোনার জন্য ডেডিকেটেড হাসপাতালসমূহে আনসার সদস্যদের ২৪ ঘন্টা ডিউটি নজরে এসেছে।

রমজানে বাজার মনিটরিং, ভিজিএফ ও টিসিবির খাদ্য বিতরণেও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে আনসার ও ভিডিপির সদস্যরা। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ভিডিও কনফারেন্সে করোনা ঝুঁকিতে আনসার ও ভিডিপির সদস্যদের দায়িত্ব পালনের কঠোর মানসিকতার প্রশংসা করেছেন।

৬১ লাখ সদস্যের এই বাহিনীর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এমন মনোভাব কেন্দ্র থেকে প্রান্ত বাহিনীটির সব সদস্যদের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে।

পাশাপাশি সরকারি ডাকে যখন-তখন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ছুটে আসার মানসিকতার কারণেই চরম দুর্দিনে তাদের পাশে থাকছে নিজেদের বাহিনী।

নিজ বাহিনীর এমন মানবিক ঔদার্য্যে খুশি গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (ভিডিপি) সদস্যরাও। মানিকগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার ভিডিপি সদস্য সোহরাব আলী বলেন, ‘আমাদের নিজেদের বাহিনী থেকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

চরম দু:সময়ে মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় প্রতিটি সদস্যের সাহস ও মনোবল আরও বাড়বে।’

একই রকম কথা জানিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট এলাকার ভিপিপি সদস্য উজ্জ্বল হোসেন বলেন, ‘সরকার যখন বলে তখন সেভাবেই কাজ করি। করোনার সময়েও ঘরে বসে থাকিনি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সুরক্ষার পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করেছি।

করোনা যোদ্ধা হিসেবে এ খাদ্য সহায়তা আমাদের জন্য প্রণোদনা। আমরা এতে আনন্দিত।’

আমাদের বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত :

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আনসার ও ভিডিপি) ২ হাজার ৭০০ দুস্থ সদস্যদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। সোমবার (০৪ মে) বেলা ১১টার দিকে সদর উপজেলার সুহিলপুর আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষণ মাঠে এ খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়।

এ সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সকল সদস্যদের মাঝে খাবার সামগ্রী তুলে দেন ৩৩ আনসার ব্যাটালিয়নের পরিচালক আজিজুল হক মজুমদার (পিভিএমএস)।

তিনি জানান, জেলার ৯টি উপজেলার প্রতিটি উপজেলায় ৩শ’ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মোট ২ হাজার ৭০০ দুস্থ সদস্যদের এ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

ঝালকাঠি জেলার ৪টি উপজেলার মোট ১ হাজার ২০০ জন দুস্থ আনসার ও ভিডিপির স্বেচ্ছাসেবী সদস্যদের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপির ঝালকাঠি জেলা কমান্ড্যান্ট শেখ ফিরোজ আহমেদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এই ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে।

বরিশালে তিন হাজার আনসার ও ভিডিপি সদস্যের মধ্যে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয়েছে। রোববার (০৩ মে) বেলা সাড়ে ১১টায় নগরের কাশিপুরে আনসার ও ভিডিপির বরিশাল রেঞ্জ ও জেলা কার্যালয়ে দুস্থ সদস্যদের মধ্যে এ খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়।

এ খাদ্য বিতরণ কার্যক্রম চলাকালে উপস্থিত ছিলেন বরিশাল রেঞ্জ কমান্ডার আশারাফুল আলম, জেলা কমান্ডেন্ট সৈয়দ ইফতেখার আলী প্রমুখ।

ফরিদপুরে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ২ হাজার ৭০০ দুস্থ সদস্যের মাঝে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। শহরের কমলাপুর চাঁদমারিতে তাদের হাতে এসব ত্রাণ তুলে দেন ফরিদপুর জেলা আনসার ও ভিডিপি কমান্ড্যান্ট মো. সেলিমুজ্জামান।

সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার দুই হাজার ৭০০ জন ভিডিপি সদস্যকে সরকারি খাদ্য সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সব সদস্যকে বাড়ি অথবা বাড়ির আঙিনায় সবজি অথবা ফলমূল চাষের আহ্বান জানানো হয়েছে।

শনিবার (০৯ মে) আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর হবিগঞ্জ জেলা কমান্ড্যান্ট তানজিনা বিন্তে এরশাদ শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ৩০০ জন সদস্যের মধ্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেন। জেলার আরও আটটি উপজেলার দুই হাজার ৪০০ জনের মধ্যে আগেই বিতরণ করা হয়েছে।

রাজশাহীতে অসহায় দুই হাজার ৭০০ ভিডিপি সদস্যেকে এক সপ্তাহের খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। পবা উপজেলায় ত্রাণ বিতরণের উদ্বোধন করেন আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী রাজশাহী রেঞ্জের পরিচালক ফখরুল ইসলাম। জেলার সবক’টি উপজেলায় এই সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

নওগাঁ জেলা আনসার ও ভিডিপির গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (ভিডিপি) উদ্যোগে ৩ হাজার ৩০০ অসচ্ছল ভিডিপি সদস্যের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

রোববার (৩ এপ্রিল) সকাল ১০টায় জেলা আনসার ও ভিডিপি কার্যালয় প্যারেড গ্রাউন্ডে সামাজিক দূরত্ব মেনে সদর উপজেলার ৩০০ স্বেচ্ছাসেবী ভিডিপি সদস্যের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন আনসার ও ভিডিপির নওগাঁ জেলা কমান্ড্যান্ট জহুরুল ইসলাম।

কালের আলো/আরআই/এসআর

Print Friendly, PDF & Email