কৃত্রিম প্রজননে বিলুপ্তপ্রায় ঢেলা মাছের পোনা উৎপাদনে বিএফআরআই’র সাফল্য
প্রকাশিতঃ 10:02 am | April 24, 2021

জ্যেষ্ঠ সংবাদদাতা, কালের আলো
কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের বিলুপ্তপ্রায় ঢেলা মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা দেখিয়েছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা। এতে ফের মানুষের পাতে বিলুপ্তপ্রায় এ মাছের সমাহার ঘটবে এবং পুষ্টি চাহিদা পূরণ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইনস্টিটিউট সূত্র বলছে, গত ২ বছর ধরে ময়মনসিংহে ইনস্টিটিউটের স্বাদু পানি গবেষণা কেন্দ্রে কৃত্রিম উপায়ে প্রজনন ঘটিয়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও বিলুপ্তপ্রায় এ মাছের পোনা উৎপাদনে গবেষণা চালানো হয়। সম্প্রতি এ গবেষণায় সফলতা অর্জন করেন গবেষকেরা। এই গবেষক দলে ছিলেন- স্বাদু পানি কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এইচ এম কোহিনুর, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শাহাআলী, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেলিনা ইয়াসমিন ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আওয়াল।
জানা যায়, স্থানীয় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদসহ বিভিন্ন উৎস্য থেকে ঢেলা মাছের পোনা সংগ্রহ করে স্বাদু পানি গবেষণা কেন্দ্রের পুকুরে সেগুলো প্রতিপালন করা হয়। এ সময়কালে মাছের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস পরীক্ষা করা হয় এবং সে অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করা হয়। একই সঙ্গে বছরজুড়ে জিএসআই ও হিস্টোলজি পরীক্ষণের মাধ্যমে ঢেলা মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করেন বিজ্ঞানীরা।
গবেষক দলের ভাষ্য অনুযায়ী, ঢেলা মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম হচ্ছে মে-জুন মাস। তবে এপ্রিল মাসের শেষ দিক থেকে এর প্রজননকাল শুরু হয়। মাছটির ডিম ধারণ ক্ষমতা হচ্ছে প্রতি গ্রামে ৭০০-৮০০টি। এছাড়া একটি স্ত্রী ঢেলা মাছ প্রায় ৬-৮ গ্রাম ওজনের হলেই প্রজনন উপযোগী হয়। প্রজনন উপযোগী পুরুষ ঢেলা মাছ আকারে অপেক্ষকৃত ছোট (৪-৫ গ্রাম) হয়।
প্রকৃতিতে স্ত্রী ঢেলা মাছের তুলনায় পুরুষ ঢেলা অপেক্ষাকৃত কম পাওয়া যায়। আমরা বিভিন্ন উৎস্য থেকে সংগ্রহের সময় দেখেছি যে, প্রকৃতিতে স্ত্রী ও পুরুষ ঢেলা প্রাপ্তির অনুপাত হচ্ছে ৪ঃ১ অর্থাৎ ৪টি স্ত্রী ঢেলার সঙ্গে মাত্র একটি পুরুষ ঢেলা থাকে।
ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ কালোর আলোকে বলেন, পুষ্টিসমৃদ্ধ ও বিলুপ্তপ্রায় ঢেলা মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবিত হওয়ায় মাঠপর্যায়ে এর পোনা উৎপাদন ও প্রাপ্যতা সহজতর হবে। একই সঙ্গে এ মাছকে সহজেই চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
গবেষণার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গবেষণায় ১০ জোড়া ঢেলা মাছকে হরমোন প্রয়োগ করা হয়। হরমোন প্রয়োগের ০৮-০৯ ঘণ্টা পর মাছটি ডিম ছাড়ে এবং ২২ ঘণ্টা পরে নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু পোনা উৎপাদিত হয়। এ সময় ডিম নিষিক্ততার পরিমাণ ছিল প্রায় শতকরা ৮০ শতাংশ।

উৎপাদিত পোনা বর্তমানে ইনস্টিটিউটের হ্যাচারিতে প্রতিপালন করা হচ্ছে বলে জানান ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ।
এদিকে মৎস্য বিজ্ঞানীরা বলেছেন, অন্যান্য দেশীয় মাছের তুলনায় ঢেলা মাছে প্রচুর খনিজ পদার্থ আছে। প্রতি ১০০ গ্রাম মাছে ভিটামিন-এ ৯৩৭ আইইউ, ক্যালসিয়াম ১২৬০ মি. গ্রাম এবং জিংক ১৩.৬০ শতাংশ; যা অন্যান্য দেশীয় মাছের তুলনায় অনেক বেশি। ভিটামিন-এ শিশুদের রাতকানা রোগ থেকে রক্ষা করে, ক্যালসিয়াম ও হাড় গঠনে সহায়তা করে। তাছাড়া জিংক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। যা এই করোনাকালে খুবই উপযোগী।
সূত্রে জানা যায়, এক সময় দেশের নদ-নদী ও হাওর-বিলে প্রচুর পরিমাণে ঢেলা মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, অতিআহরণ ও জলাশয় সংকোচনের কারণে ঢেলা মাছের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র বিনষ্ট হয়ে যায় এবং এ মাছটি বিলুপ্তির তালিকায় চলে আসে। ফলে ঢেলা মাছ এখন প্রায় দুস্প্রাপ্য। কালেভদ্রে বাজারে পাওয়া গেলেও তা অতি উচ্চ দামে বিক্রি হয়ে থাকে।

এমতাস্থায় কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় ঢেলা মাছকে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে এবং চাষের মাধ্যমে এর উৎপাদন বাড়বে বলে মনে করেন মৎস্য বিজ্ঞানীরা।
ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, শুধু ঢেলা মাছই নয়, পাবদা, গুলশা, টেংরা, বৈরালীসহ ইতোমধ্যে ২৪টি দেশীয় ও বিলুপ্তপ্রায় মিঠাপানির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। ফলে এসব মাছের উৎপাদন ও প্রাপ্যতা সাম্প্রতিকালে বেড়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮-০৯ সালে চাষের মাধ্যমে দেশীয় ছোটমাছের উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার মেট্রিকটন। পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় তা বেড়ে পেয়ে ২০১৮-১৯ সালে হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। এই হিসেবে বলা যায়, গত ১২ বছরে চাষে দেশীয় মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। বর্তমানে পিয়ালী, কাজলী, বাতাসি, কাকিলা, রাণীও গাং, টেংরাসহ আরো ১০টি মাছ নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা।

এ প্রসঙ্গে বিএফআরআই ডিজি ড. ইয়াহিয়া মাহমুদের ভাষ্য, বিপন্ন প্রজাতির সকল দেশীয় মাছকে খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। এরই ধারাবাহিকতায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইনস্টিটিউটে ছোট মাছের গবেষণা কার্যক্রম আরও জোরদার করা হয়েছে।
জানা যায়, দেশীয় মাছ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহস্থ স্বাদুপানি কেন্দ্রে ২০২০ সালে একটি লাইভ জীন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশীয় মাছ সংরক্ষণসহ গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০২০ সালে বিএফআরআই-কে একুশে পদকে ভূষিত করে সরকার।
জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম কালের আলোকে বলেন, দেশের প্রতিটি প্রান্তে দেশীয় প্রজাতির মাছ ছড়িয়ে দিতে সরকার কাজ করছে। সরকারের নানামুখী কার্যকর পদক্ষেপের ফলে মৎস্য গবেষণাতে নতুনত্ব এসেছে। আমাদের মৎস্য বিজ্ঞানীরাও অনন্য সাফল্যের নজির স্থাপন করেছেন। এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ছোট ছোট দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় মাছ তারা ফিরিয়ে এনেছেন। এবার কৃত্রিম প্রজননেও বিলুপ্তপ্রায় ঢেলা মাছের পোনা উৎপাদনে তাঁরা সাফল্য অর্জন করেছেন। এটা বিএফআরআই’র বিজ্ঞানীদের সক্ষমতারই একটি উদাহরণ।’
কালের আলো/এসকে/এমএম