সিনহা হত্যাকান্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক ‘শাস্তি’ হলেই ‘সন্তুষ্ট’ হতে চান সেনাপ্রধান (ভিডিও)
প্রকাশিতঃ 7:48 pm | September 02, 2020

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো; চট্টগ্রাম ঘুরে এসে :
দেশ-বিদেশে আলোচিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশা করে অনমনীয় সাহস ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।
‘স্পর্শকাতর’ এ হত্যাকান্ডকে ঘিরে দেশপ্রেমিক সেনা ও পুলিশ বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করানো এবং ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরির অপচেষ্টাও রুখে দিয়েছেন নিজের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের দৌলতেই। স্বয়ং গণমাধ্যমকর্মীরাও এ বিষয়ে এবার সরাসরি ‘কৃতিত্ব’ দিয়েছেন সেনাপ্রধানকে।
তবে জেনারেল আজিজ আহমেদ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, ‘আগে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে।’ এটি নিশ্চিত হলেই ‘সন্তুষ্ট’ হতে চান সেনাপ্রধান। অতীতের মতোই এবারও এ হত্যাকান্ডকে তিনি নৃশংস, জঘন্যতম ও ঘৃণিত-এই তিনটি শব্দেই উপস্থাপন করেছেন।
সেনাবাহিনীর মতো পুলিশ বাহিনীও এ হত্যাকান্ডকে একই চোখে দেখছে বলেও মন্তব্য করেছেন। পাশাপাশি সিনহার মতোন ঘটনা সেনাবাহিনীর কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত কারও সাথেই যেন না ঘটে নিজের সেই প্রত্যাশার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ৬টি ইউনিটকে রেজিমেন্টাল কালার প্রদান অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পুনরায় এ হত্যাকান্ডের বিষয়ে এভাবেই পুনরায় নিজের শক্ত অবস্থানের কথা জানান দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।

আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক ইউনিট সমূহকে সেনাবাহিনী তথা দেশমাতৃকার সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য রেজিমেন্টাল কালার প্রদানের রেওয়াজ রয়েছে।
এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৬ সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন, ১৮ বীর, ২০ বীর, ২১ বীর, ২২ বীর এবং ২৩ বীর এদিন চট্টগ্রাম সেনানিবাসের এম আর চৌধুরী প্যারেড গ্রাউন্ডে কালার প্যারেডে অংশগ্রহণ করে এবং সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রেজিমেন্টাল পতাকা গ্রহণ করে।
এ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বুধবার (০২ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮ টার দিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের উদ্দেশ্যে নিজেদের বিমানে যাত্রা করেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। চট্টগ্রাম সেনানিবাসস্থ ইষ্ট বেংগল রেজিমেন্ট সেন্টারের এম আর চৌধুরী প্যারেড গ্রাউন্ডে সেনাপ্রধান পৌঁছলে আর্মি ট্রেনিং এন্ড ডকট্রিন কমান্ডের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ এবং ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও চট্টগ্রামের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান তাঁকে অভ্যর্থনা জানান।
পরে প্যারেড কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মো: রফিকুল ইসলাম এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দল কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করে এবং সেনাবাহিনী প্রধান’কে সালাম প্রদান করেন।

গণমাধ্যমকর্মীদের চার প্রশ্নের জবাবে যা বলেছেন সেনাপ্রধান
অনুষ্ঠান শেষে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ অপেক্ষমান গণমাধ্যম কর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের হত্যাকান্ডকে ঘিরে তাঁর মন্তব্য জানতে চাইলে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমি বলবো অত্যন্ত নৃশংস ও জঘন্যতম হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
এটার তদন্ত হচ্ছে। আমি সেনাপ্রধান হিসেবে আশা করতে চাই যে, তদন্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে। এবং যারা প্রকৃত অপরাধীদের উপযুক্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের কোন ঘটনা সেনাবাহিনীর কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত কারও সাথে যেন না ঘটে, আমি সেটা প্রত্যাশা করি।’
এ হত্যাকান্ডকে ঘিরে দু’টি বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা রুখে দিতে সেনাপ্রধানের দূরদর্শী সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেন গণমাধ্যমকর্মীরা।
একই সঙ্গে এ হত্যাকান্ডকে ঘিরে একটি মহল পরিকল্পিতভাবেই যে দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির ‘ছক’ কষেছিল এমন ইঙ্গিতও ছিল তাদের প্রশ্নে।
আর এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে সেনাপ্রধান তাদের সঙ্গে ‘সহমত’ পোষণ করেই বলেন, ‘দেখুন আমরা যুগ যুগ ধরে দেখে আসছি যেকোন একটা ঘটনা ঘটলে কেউ না কেউ এটার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে।
এবারও অনেকে চেষ্টা করেছিল। হয়তো এখনও করছে। এই ধরনের ঘটনা চলতেই থাকবে। তবে সচেতন মানুষ এগুলো বুঝে যে, একটা ঘটনা ঘটেছে অবশ্যই অত্যন্ত একটা নৃশংস ঘটনা, ন্যাক্কারজনক ঘটনা।
সেটাকে আপনারও দেখেছেন শুধু সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেই এটাকে ঘৃণা জানানো হয়নি এবং পুলিশ প্রধানও সেদিন এসেছিলেন।
তারাও সেই ঘটনার জন্য দু:খ প্রকাশ করেছেন এবং সকলে এই ঘটনা নিয়ে মর্মাহত হয়েছে। এরকম একটা ঘটনাকে নিয়ে কেউ যদি অন্যকিছু করার চেষ্টা করে সেটা সত্যিই খুব দু:খজনক ঘটনা এবং সেটি কাঙ্খিত নয়।’
এ বিষয়ে সেনাবাহিনী নিজস্ব কোন তদন্ত করেছে কীনা এ প্রশ্নের উত্তরে জেনারেল আজিজ আহমেদ নিজ বাহিনীর নিয়ম কানুনের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।

তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর কোন সদস্যের অস্বাভাবিক কোন বিষয় হলে সেটার ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই নিজস্ব তদন্ত হয়, সেটা আমাদের বাহিনীর প্রয়োজনে। আমরাও এ ঘটনার পর একটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি এবং তদন্ত হচ্ছে।’
সিনহা হত্যাকান্ডের পর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে কোন সুপারিশ দেওয়া হয়েছে কীনা জানতে চাইলে সেনাপ্রধান বলেন, ‘দেখুন এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে কোন সুপারিশ দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করিনা।
কারণ এই ঘটনার পরপর সরকারের পক্ষ থেকে একটি যৌথ তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে।
এবং এই তদন্ত টিমের প্রতি সেনাবাহিনী এবং আমি নিশ্চিত পুলিশেরও এ ব্যাপারে সমর্থন রয়েছে। এই তদন্ত দল তাদের নিকট যেটা উপযুক্ত তারা মনে করবে তারা সেই সুপারিশগুলোই সরকারকে করবে। এখানে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সুপারিশ করার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।
তদন্ত নিয়ে আপনি সন্তুষ্ট কীনা? গণমাধ্যম কর্মীদের এমন প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ এক বার্তাই দিয়েছেন সেনাপ্রধান। রোমহর্ষক এ হত্যাকান্ডে জড়িত খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলেই সন্তুষ্টির প্রসঙ্গটি আসবে জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘তদন্ত হচ্ছে, এ ব্যাপারে কোন কিছু বলা যাবে না।
কারণ এটা সবাই জানেন অত্যন্ত জঘন্য একটা ঘটনা ঘটেছে। এবং সেটার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে। এবং এটা হলো তদন্তে বেরিয়ে আসবে। শাস্তির আগে সন্তুষ্টির বিষয় বলার কোন সুযোগ নেই।’

চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের সারসংক্ষেপ
গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে ‘গাড়ি তল্লাশিকে’ কেন্দ্র করে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ঘটনার পর বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দুটি ও রামু থানায় একটি মামলা করে পুলিশ।
এ মামলায় এখন পর্যন্ত সাত পুলিশ সদস্য, এপিবিএনের তিন সদস্য ও টেকনাফ পুলিশের করা মামলার তিন সাক্ষীসহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। পরে গত ৫ আগস্ট কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা করেন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। মামলায় ৯ জনকে আসামি করা হয়।
গত মঙ্গলবার (১ সেপ্টেম্বর) এ হত্যার ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলার তিন সাক্ষীকে তৃতীয়বারের মতো তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ডপ্রাপ্তরা হলেন- টেকনাফের বাহারছড়ার মারিশবুনিয়ার নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দীন ও মোহাম্মদ আইয়াস।
শুনানি শেষে আদালত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে তিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন বলে জানান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এএসপি খাইরুল ইসলাম। তিনি জানান, একদিনের রিমান্ড শেষে ওসি প্রদীপ কুমার দাশকেও আদালত হাজির করা হবে।
গত ২০ আগস্ট প্রথম দফায় ৭ দিন ও ২৫ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। সিনহা হত্যা ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে র্যাবের একটি দল টেকনাফের মারিশবুনিয়া এলাকা থেকে গত ৯ আগস্ট পুলিশের দায়ের করা মামলার এই সাক্ষীদের গ্রেফতার করে।
কালের আলো/এমএএএমকে