এমন ভয়ানক সব ‘গুজব’ আর কতদিন?
প্রকাশিতঃ 9:36 am | August 31, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী, ফাযায়েলে আমল, পূর্ণাঙ্গ নামাজ শিক্ষা-এমন ছয়টি বইয়ের একপাশে কাগজে সাঁটানো ‘উগ্রবাদী বই’! ডান পাশেই একটি কালো সাইনবোর্ডে লেখা র্যাব-৬, যশোর ক্যাম্প।
রোববার (৩০ আগস্ট) থেকে এমন ছবি সম্বলিত একটি পোস্ট ঘুরপাক খাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে।
সম্পূর্ণ ধর্মীয় উস্কানিমূলক ও বিদ্বেষপূর্ণ এই পোস্টে চরমভাবে ‘দোষারোপ’ করা হচ্ছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানকে (র্যাব)। প্রথম দেখাতেই যে কেউ বিভ্রান্ত হবেন, হারাতে পারেন হুঁশও!
বুঝে না বুঝেই অনেকেই ধর্মীয় এসব বইকে র্যাব ‘উগ্রবাদী বই’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে বলে ‘গুজব’ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সন্ত্রাসের পাশাপাশি জঙ্গিবাদ দমনে র্যাবের ‘শুন্য সহিষ্ণুতা’ নীতি দেশের পরিমন্ডল ছাপিয়ে বিশ্বে প্রশংসিত হলেও প্রকৃত অর্থেই বানানো ছবির ধর্মীয় এসব সাধারণ বইকে র্যাব কখনই ‘উগ্রবাদী বই’ হিসেবে প্রচার করেনি।
নিয়মিত অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে জঙ্গিবাদের শেকড় মূলোৎপাটনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে বিশেষায়িত এই এলিট ফোর্স।
নিজেদের প্রতিটি অভিযানের পরপরই প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত আনুষ্ঠানিকভাবেই গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করছে।
কিন্তু সম্পূর্ণ অসত্য, বিকৃত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্যের মাধ্যমে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের মাধ্যমে পুরোমাত্রায় দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্যই র্যাবের নাম জড়িয়ে এবার ফটোশপের কারসাজির মাধ্যমে ‘ভুয়া ছবি’ বানিয়ে ভয়ঙ্কর এমন ‘গুজব ভাইরাস’ ছড়ানো হয়েছে।
এমনকি ছবিটির ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ প্রমাণে ধুরন্ধর চক্রটি ডিবিসি’র মতোন জনপ্রিয় একটি নিউজ চ্যানেলের লোগোও ব্যবহার করেছে। ভাইরাল হওয়া এ ‘ফেক পোস্ট’ ইতোমধ্যেই নজরে এসেছে র্যাব-৬ কর্তৃপক্ষেরও।
কালের আলো’র সঙ্গে রোববার (৩০ আগস্ট) রাতে আলাপে সংশ্লিষ্ট অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রওশনুল ফিরোজ এ বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
র্যাব-৬’র এই অধিনায়ক বলেছেন, ‘পুরোপুরি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই পোস্টের মাধ্যমে কারা ধর্মপ্রাণ মানুষকে উস্কে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছে তাদের সনাক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে।
যেসব ফেসবুক আইডি থেকে এ সংক্রান্ত বানোয়াট ও ভিত্তিহীন পোস্ট দেওয়া হয়েছে সেগুলো নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

হঠাৎ করেই সোশ্যাল মিডিয়াতে এমন ভয়ানক মিথ্যাচার চালিয়ে র্যাবের বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তোলার অপপ্রয়াসের নেপথ্যে দেশের বাইরে থেকে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে বলেও মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, ‘সেনাবাহিনীর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের মতোন ‘স্পর্শকাতর’ হত্যাকান্ডের তদন্তে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গেই ইতিবাচক অগ্রগতির পাশাপাশি কক্সবাজার-টেকনাফে মাদক বাণিজ্যের রাশও টেনে ধরেছে র্যাব।
কঠিন পরিস্থিতিতেও শতকোটি টাকার ইয়াবার চালান ধরার মাধ্যমে মাদকবিরোধী অভিযানও জোরদার করেছে।
ফলশ্রুতিতে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটি বিশেষ মহলের ‘দিবাস্বপ্ন’ মাঠে মারা পড়ায় আবারও ধর্মকে পুঁজি করে গুজব রটানোর মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার পুরনো পন্থাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে।’
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী বারবার গুজব সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন বা সতর্ক করলেও সহানুভূতিসম্পন্ন বিবেকবোধ জাগ্রত হচ্ছে না। ডটকম দুনিয়ায় মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহও বন্ধ হচ্ছে না।
ধর্মীয় উস্কানি ও গুজবের বিষয়ে পুলিশের দায়িত্বশীলদের সর্বোচ্চ তৎপর থাকার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশের আইজি ড.বেনজীর আহমেদ, বিপিএম (বার)।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছেন। বলেছেন, ‘গুজবের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একসঙ্গে কাজ করছে।’
র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনও বিনয়ের সঙ্গেই বলে আসছেন, ‘আবেগতাড়িত হয়ে, সত্যতা যাচাই না করে কোন গুজবে লাইক, শেয়ার বা কমেন্টস করবেন না। আপনারা সত্য জানুন।
প্রয়োজনে আমাদের ফেসবুক পেইজ, র্যাব সাইবার ভেরিফিকেশন সেন্টারের সহায়তা নিন। সন্দেহজনক যে কোন তথ্য দিন, আমরা যাচাই বাছাই করে আপনাদের যে কোন সহায়তা করবো।’
গুজবের উৎস ফেসবুক-ইউটিউব
কেবল র্যাবই নয়, দিনের পর দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইন-আদালত, সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধান, পুলিশসহ রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ভার্চুয়াল জগতে ভয়ানক সব গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
অতীতেও সরকারকে বিপাকে ফেলতে পিলখানা হত্যাকান্ড নিয়ে বহুমুখী গুজব, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, সরকারের মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতুকে জড়িয়ে ‘ছেলেধরা’ গুজব ছড়িয়ে নিরীহ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা- প্রতিটি গুজবের ‘উৎস’ হিসেবে হালে নেতিবাচক পরিচিতি পেয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক।
বাদ যায়নি ইউটিউবও। কারও নামে কুৎসাচারের কন্ঠজুড়ে বিভিন্ন ইউটিউব অ্যাকাউন্ট থেকেও ছাড়া হচ্ছে। নেটিজেন দুনিয়ার সাধারণ মানুষ এসব নিউজের সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাই না করে লাইক, শেয়ার, কপি ও ট্যাগের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
অনেকেই অভিযোগ করেছেন, মূল্যবোধবর্জিত কর্মকান্ডের মাধ্যমে সরকার প্রধানসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চরিত্র হননের অনৈতিক এক হাতিয়ার হয়ে উঠছে ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল। প্রযুক্তির ‘আদর্শ ব্যবহার’ নিশ্চিত না হওয়ায় গুজব ভয়াবহ আকার নিয়েছে।
অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, হিটলারের জামানায় গুজবের উদ্ভাবক তাঁর গুণধর তথ্যমন্ত্রী গোয়েবলস নিজেও এখন বেঁচে থাকলে কৌশলী বা আনাড়ি-অথর্ব মার্কা গুজবের এসব প্রবণতায় রীতিমতো লজ্জা পেতেন!
করোনাকালে নানা বিষয়ে ‘গুজব’ মাথাচাড়া দিচ্ছে। ‘গুজব স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তৈরি হয় না।
ভেজা বা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে যেমন আগাছা বা ফার্ন জন্মে তেমনি গুজবের জন্য একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ লাগে’ এমনটিই মনে করেন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার।
সম্প্রতি গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, ‘ঘোলাটে পরিবেশে গুজব সৃষ্টিকারীরা তাদের মনগড়া কাহিনী প্রচার শুরু করে। যেমন গুজব ছড়ানো হচ্ছে- লাখ লাখ মানুষ মরছে, গোপন করা হচ্ছে, লুকিয়ে ফেলা হচ্ছে এসব।
বর্তমানে নাগরিক সাংবাদিকতার কারণে কোনো বিষয় গোপন করা কঠিন। গুজব রটনাকারীদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। র্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল ভার্চুয়াল জগতে মনিটরিং অব্যাহত রেখেছে।’
গুজবের আড়ালে ও খল চরিত্রে কারা?
কোনভাবেই গুজব সংক্রমণ বন্ধ করা যাচ্ছে না। গুজবের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে নিয়মিতই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।
দেশের ভেতরে গুজবের সঙ্গে সম্পৃক্তদের গ্রেফতার করা হলেও যুক্তরাজ্য বা কানাডা থেকে নিয়মিতই অপপ্রচার-প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর খলনায়কদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
সূত্র মতে, গুজবের ‘মেইন সেন্টার’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে যুক্তরাজ্য ও কানাডাকে। একটি দেশে পলাতক মৃতপ্রায় একটি রাজনৈতিক দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান সাইবার ওয়ার্ল্ডে পারিশ্রমিক ভিত্তিতে কথিত কয়েক গণমাধ্যমকর্মীকে নিয়োগ দিয়েছেন।
নিজের মতোই দন্ডিত ও পলাতক হওয়ায় সহজেই তারা ওই নেতার আনুকূল্যও পেয়েছেন। রাষ্ট্রবিরোধী ওই রাজনীতিকের বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টেই কখনও দৃশ্যপটে হাজির হচ্ছেন চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী কিংবা দেলোয়ার হোসেনের মতোন অবাঞ্ছিত অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা।
কিন্তু দেশপ্রেমের আড়ালে তাদের বিকৃত, ভন্ডামি, কপটতা ও স্বাধীনতা বিরোধী চেতনা প্রকাশ্যে আসার পর খলচরিত্রে অভিনয়ে তাঁরা নেটিজেন দুনিয়ায় ধিক্কৃত হচ্ছে জনেজনে।
কথিত কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেলে ধূর্ত, নীচ ও মিথ্যাবাদীর যোগ্য চরিত্রায়ণে তাদের মতলববাজি ধরা পড়েছে।
বিদেশ থেকেও গুজব সৃষ্টি করা হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড.হাছান মাহমুদ।
বিভিন্ন সময়ে তিনি বলেছেন, ‘যারা গুজব ছড়াবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকার বদ্ধপরিকর।’
তথ্য অধিদপ্তর ও নিজ মন্ত্রণালয়ের গুজব প্রতিরোধ সেলের কর্মকর্তারা পুরো বিষয়গুলো নজরদারি করছেন জানিয়ে ওই সময় মন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ‘বিদেশ থেকে যারা গুজব ছড়াচ্ছেন তারা হয়তো মনে করছেন তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
কিন্তু তারা বাংলাদেশের নাগরিক সুতরাং বাংলাদেশের নাগরিক যেখান থেকেই অপকর্ম করুন না কেন, সরকার আইনগতভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে এবং তা করবে।’
কালের আলো/এসএকে/এমএএএমকে