শোকের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত ব্যারিস্টার তাপস

প্রকাশিতঃ 5:50 pm | August 15, 2020

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

শোকাবহ ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ফজলুল হক মনির ছেলে তাপস বলেন, ‘অন্যদের বাবা-মায়ের কত স্মৃতি। আমারও তো ইচ্ছে করে অন্যদের মতো বাবা-মায়ের স্মৃতিচারণ করতে।’

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুকে হারানোর শোক অনুভব করেছিলেন বিশ্বনেতারা

আবেগতাড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘অনেক ভেবেছি, অনেক চিন্তা করেছি, অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোনো স্মৃতিই পাইনি। শুধু আবছা আবছা একটি স্মৃতি। আমার বাবা-মার স্মৃতি বলতে শুধু মেঝেতে পড়ে থাকা নিথর রক্তাক্ত দুটি লাশ। এছাড়া আমি আর কিছুই মনে করতে পারি না!’

২০১৮ সালের ১৫ আগস্ট দেশের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এমনটিই উল্লেখ করা হয়।

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধু পকেট থেকে ৩০০ টাকা বের করে দেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে!

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের গুলিতে প্রাণ হারান তাপসের বাবা শেখ ফজলুল হক মনি এবং মা আরজু মনি। বাবা-মাকে হারিয়ে তাপস ও তার ভাই শেখ ফজলে শামস পরশ এতিম হয়ে পড়েন। সম্প্রতি শেখ ফজলে শামস পরশকে যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আরও জানা যায়, ওই সময় তাপসের বয়স ছিল চার বছর এবং পরশের ছয় বছর। বঙ্গবন্ধুর বোন শেখ আছিয়া বেগমের বড় ছেলে মনি ছিলেন আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা। স্বাধীনতাযুদ্ধে অন্যতম প্রধান গেরিলা বাহিনী ‘মুজিব বাহিনী’ তার নির্দেশে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গঠিত ও পরিচালিত হয়েছে।

আরও পড়ুন: অনিবার্ণ সূর্যের প্রখর ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু; সেনাপ্রধানের সারল্য-ঐশ্বর্যমন্ডিত উপস্থাপন

ব্যারিস্টার তাপস বলেন, ‘আমি তখন অবুঝ ছিলাম। কিন্তু এখন বুঝ হলেও মনকে বুঝ দিতে পারি না। কোনো সন্তান যখন ঘরে ফিরে যায় তখন কেন তার মাকে পাবে না! কেন তার মাকে আলিঙ্গন করতে পারবে না।’

‘কেন তার মাকে সেবা করতে পারবে না! স্মৃতির মণিকোঠায় ভেসে ওঠা দৃশ্যপট বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর নাতি তাপস বলেন, ‘এই মুহূর্তে মনে পড়ছে শুধুই বাবার লাশ, সাদা গেঞ্জি পরা। সিঁড়ির চৌকিতে পড়ে আছে, গলায় গুলির রক্তাক্ত দাগ।

এখনও গুলির দাগটি ভেসে ওঠে। আরেকটি দৃশ্য স্মৃতিতে আটকে আছে- বাবা-মার লাশ নিয়ে যাওয়ার পর সিঁড়িতে পড়ে থাকা জমাট বাঁধা রক্ত। এর বেশি কিছু মনে নেই। মনে নেই বাবা-মার আদর-আলিঙ্গন, হাসি-কান্না।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র তাপস সেদিন আরও বলেন, ‘আগস্ট মাসের প্রথম দিন থেকেই আমাদের বুকের ব্যথা অনেক বেড়ে যায়। আমাদের মনটা কালো ছায়ায় ঢেকে থাকে। বিচার হয়েছে বলে তবুও এখন একটু সান্ত্বনা পাই।

আমি নিজেও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পেরেছি। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন এই বিচার না দেখে বুকভরা কষ্ট নিয়ে মারা গেছেন। এখনও অনেক খুনি বিদেশে পালিয়ে আছে। বিদেশে পালিয়ে থাকা এসব আসামিকে দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করতে হবে।’

জীবনের দুর্বিষহ স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে তাপস বলেন, ‘আত্মীয়দের বাসায় কিছু দিন লুকিয়ে থাকতে হয়েছে আমাদের। প্রায় দুই বছর এভাবে লুকিয়ে চলার পর ১৯৭৮ সালে আমরা ভারতে চলে যাই।

দাদি আমাদের সেখানে নিয়ে যান। চাচারা সবাই আগেই ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিছু দিন ভারতে থাকার পর আবার আমরা দেশে ফিরে আসি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যখন বাসা ভাড়া নিতে যেতাম, আমাদের কেউ বাসা ভাড়া দিত না। আমরা বাসা ভাড়া পেতাম না। আত্মীয়দের বাসায় থাকতাম। অনেক দিন পর লালমাটিয়ার একটি বাসায় উঠি।

আমাদের পড়ালেখা করতেও বাধা দেয়া হতো। ভর্তি হতে দেয়া হতো না। আমাদের স্কুলেও বেশি দিন থাকতে দেয়া হতো না। স্কুল কর্তৃপক্ষ শঙ্কার মধ্যে থাকত। অনেক কষ্টে পড়ালেখা করতে হয়েছে আমাদের।’

দাদা-দাদি, দুই চাচা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, সর্বোপরি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার অবদানের কথা স্মরণ করেন তাপস। তিনি বলেন, তাদের ভালোবাসা, আদর ও স্নেহে আজ এ অবস্থানে আসতে পেরেছি।

ব্যারিস্টার তাপস আরও বলেন, ‘আমাদের এতিম দুই ভাইয়ের একমাত্র ছায়া ছিলেন আমার দাদি বঙ্গবন্ধুর মেজ বোন শেখ আছিয়া বেগম। আমাদের বোঝানোর জন্য দাদি বলতেন, বাবা-মা বিদেশে আছে। তোমরা কেঁদো না, এই তো চলে আসবে। কিছু দিন পরই চলে আসবে।’

ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্যও ছিলেন ফজলে নূর তাপস। তিনি বলতে থাকেন, ‘আমরা যখন বুঝতে শিখলাম যে বাবা-মাকে আর পাব না, তাদের অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। সেই সময় আরেকটি উপলব্ধি এলো, ওই অন্যায়ের কোনো বিচার আমরা পাব না।

বিষয়টি দীর্ঘদিন আমাদের তাড়িত করেছে। বিচারহীনতার কষ্ট অন্য রকম। আমার মৌলিক অধিকার কিন্তু সেটি আমাকে দেয়া হবে না! ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর যখন বিচার কার্যক্রম শুরু হল, নতুন এক শঙ্কায় পেয়ে বসল।

বিচার সম্পন্ন করতে পারব তো! দীর্ঘ ৩৪ বছর পর সেই বিচারের কার্যক্রম শেষ হয়েছে। ফাঁসির আদেশও কার্যকর হয়েছে।’

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আইনজীবী হওয়ায় দু’বার হামলার শিকার হয়েছেন জানিয়ে তাপস বলেন, ‘পুরানা পল্টনের বাংলার বাণী অফিসে তার ওপর সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা ঘটে। সেই সময় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার আগেই ওই হামলার পরিকল্পনা করা হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই।’

প্রয়াত শেখ ফজলুল হক মনি’র কনিষ্ঠ এ সন্তান বলেন, ‘হাজারীবাগের পার্কের মধ্যে দ্বিতীয় হামলার শিকার হই। এসব হামলার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছে তাদেরই প্রচেষ্টা ছিল এটা।’

১৫ আগস্ট তেমন কোনো কর্মসূচি পালন করেন না ফজলে নূর তাপস। সকালে ওঠে নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করেন। এরপর দলীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ধানমণ্ডি ৩২-এ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, বনানী কবরস্থানে নিহত আত্মীয়স্বজনের কবরে দোয়া ও মোনাজাত করেন।

ফুফু শেখ হাসিনার সঙ্গে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বাসায় ফিরে তিনি একাকী থেকে নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া মোনাজাত করেন।

কালের আলো/বিএসকে/এমএম

Print Friendly, PDF & Email