সকল অশুভ অদৃশ্য শক্তি পরাভূত করতে প্রয়োজন গবেষণা ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার

প্রকাশিতঃ 5:25 pm | April 13, 2020

প্রফেসর ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন :

আমি প্রথমেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাঁর নেতৃত্বে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সেই সাথে স্মরণ করছি সকল বীর শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই দেশ পেয়েছি।

এই বছরটি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, আমরা বিশ্বজুড়ে একটি দুর্যোগ মোকাবেলায় আছি। বাংলাদেশকে এ দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি নিরলসভাবে পরিশ্রম করছেন। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছি।

একাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা যেভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এবারও বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে আমরা সেভাবে এই বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলা করবো। আমি সুনিশ্চিত আমরা এর থেকে অচিরেই পরিত্রাণ পেয়ে আরও ভালোভাবে এগিয়ে যাবো।

এই প্রোগ্রামটি একটি ক্রান্তিকালীন প্রোগ্রাম। এই আয়োজনে যারা রয়েছেন- তাদের সবার প্রতি আমার শুভেচ্ছা। আমি ধন্যবাদ জানাই আইসিটি প্রতিমন্ত্রীকে যিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মানে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এই ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। তার পরিকল্পনায় এদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম থেকেই এদেশকে আধুনিক বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একটি ফ্রেমওয়ার্ক দিয়েছেন। যেটি হচ্ছে- ভিশন ২০২১, ২০৩০, ২০৪১ (উন্নত বাংলাদেশ) এবং ২০৭১। ২০৭১ সালে আমরা স্বাধীনতার একশত বছর পালন করবো। আমাদের রয়েছে শতবর্ষব্যাপী ডেল্টা প্ল্যান। এই ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়নে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা সবাই একতাবদ্ধও এ ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়নে।

বর্তমানে দেশে যে দুর্যোরগটি ছড়িয়ে পড়েছে তা মোকাবিলায় প্রথম সাড়িতে রয়েছেন চিকিৎসকেরা। আমরা প্রথমেই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি তাদের প্রতি। সবার আগে এগিয়ে এসেছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, আইসিটি মন্ত্রণালয়, এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই দুর্যাগ মোকাবেলায় নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা।

আমি সবাইকে আতঙ্কিত না হয়ে মনোবল দৃঢ় রেখে একতাবদ্ধভাবে এই দুর্যোগ মোকাবেলা করার আহ্বান জানাবো। আমি তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে গবেষণা করি, পড়ালেখা করি।

এই মুহূর্তে আমি আমার লেখা ‘অদৃশ্য প্রযুক্তি’ থেকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। যা এই ক্রান্তিকালে আলোচ্য হতে পারে। ‘অদৃশ্য প্রযুক্তি’ বইয়ের “স্বপ্নচারী মানুষের নবদিগন্ত” নিবন্ধের কিছু অংশ পড়ে শোনাতে চাই-

“মানুষ স্বপ্নচারী। মানব সভ্যতা সবসময়ই প্রযুক্তি নির্ভর এবং সামনের দিকে যেতে চায়। মানুষ কখনোই তার অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তাই কম্পিউটিং নিয়েও মানুষ উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করেছে। কম্পিউটার স্বপ্নচারী মানুষকে নিয়ে যাবে নবদিগন্তে। যার ফলে ভবিষ্যতে মানুষ বিমানব্যবস্থাকে আরো আধুনিক এবং নিরাপদ করে তুলতে পারবে।

জেট বিমানের সফটওয়্যার বর্তমানে আরো নিরাপদ করা খুব জটিল হলেও ভবিষ্যতে তা সম্ভব হবে। আরো বহুদুরের অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র আবিষ্কার করা সম্ভব হবে। মানুষের ক্যান্সার আগে থেকেই নির্ণয় করা সম্ভব হবে যার ফলে বেঁচে যাবে অসংখ্য জীবন। আবহাওয়ার পূর্বাভাস আরো নিখুত হবে যার ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের মৃত্যুর হার কমে যাবে। অ্যামিনো অ্যাসিড এবং DNA sequence বিশ্লেষণের মাধ্যমে অত্যাধুনিক ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে। এই সকল কিছু সম্ভব হবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে।”

বর্তমানে উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে পর্যদুস্ত। সেখানে আমাদের কী করণীয়? আমাদের করণীয় হচ্ছে, আমাদের এ বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় আরো বেশি মনোনিবেশ করতে হবে। এ বিষয়ক গবেষণায় প্রাধান্য দিতে হবে। যাতে আমরা আমাদের দেশে জাতীয় দুর্যোগসহ যেকোনো সমস্যা সমাধানে ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে সহযোগিতা করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সেভাবে কাজ করতে পারে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় এগিয়ে এসেছে। আমাদের আইসিটি মন্ত্রণালয়ও তাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করছে। এগিয়ে এসেছে ইউজিসিও।

এ কারণেই আমি এখানে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের বিষয়টি এনেছি। আমরা যদি গবেষণার মাধ্যমে কোয়ান্টাম কম্পিউটার আবিষ্কার করতে পারতাম, তাহলে আমি মনেকরি আমরা বায়োলজিক্যাল সিক্যুয়েন্স তৈরি করতে পারতাম। ফলে আমরা যেকোনো অদৃশ্য শক্তিকেও পরাভূত করতে পারতাম। আমরা নভেল করোনাভাইরাসের মতো শক্তিকে সহযেই পরাভূত করতে পারতাম।

আমি বিশ্বাস করি, একদিন সমৃদ্ধ গবেষণার ফলে কোনো অদৃশ্য শক্তিও আমাদের নতজানু করতে পারবে না। মানুষ অসহায় হয়ে পেছনে পড়ে থাকবে না। এগিয়ে যাবে। আমি শিক্ষার্থীদের একটি কথা বলতে চাই- তাদের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের সময়েও জ্ঞান অর্জনের পথে নানা বাধা-বিপত্তি এসেছে। তাই জ্ঞান অর্জনের জন্য একনিষ্ঠ হতে হবে। জ্ঞানের ভাষা বুঝতে হবে।

গ্যালিলিও যে কথাটি বলেছিলেন- Philosophy is written in this grand book, the universe, which stands continually open to our gaze. But the book cannot be understood unless one first learns to comprehend the language and read the letters in which it is written. অর্থাৎ “দর্শন শাস্ত্র লিপিবদ্ধ আছে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নামক মহান বইটিতে যা সবর্দা আমাদের সামনে উন্মুক্ত। কিন্তু এই বইটি একজন ততক্ষণ বুঝতে সক্ষম হবে না, যতক্ষণ না এর ভাষা ও বর্ণমালা বুঝতে পারবে। এটি লেখা হয়েছে গণিতের ভাষায় এবং এর বর্ণমালাগুলো হলো ত্রিভূজ, বৃত্ত এবং জ্যামিতিক আকৃতিসমূহ।”

আমি এর মাধ্যমে আপনাদের বোঝাতে চাই যে, আমরা যদি গবেষণায় এবং শিক্ষায় মনোনিবেশ করি, আমরা গ্যালিলিওর ভাষায় যদি দেখতে চাই-তাহলে আমাদের মহাবিশ্বকে বুঝতে হবে। আর মহাবিশ্বকে বুঝতে হলে মহাবিশ্বের ভাষা জানতে হবে। সেই ভাষাই হচ্ছে বিজ্ঞান, গণিত এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং।

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং যদি আমরা গবেষণা করি, বিজ্ঞানকে চর্চা করি, প্রযুক্তিকে চর্চা করি, তাহলে আমরা এগিয়ে যাবো-এটা আমি একদম দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ।

আরেকটি বই আপনাদের হয়তো অনেকেরই চেনা “লাইফ অন দ্য এজ। লিখেছেন- জিম আল খালিলি ও ম্যাক ফাদেন। এটি তাদের তিন বছরের পরিশ্রমের ফল। এটি অনেকের কাজে লাগতে পারে। এটি দ্য কামিং অব কোয়ান্টাম বায়োলজি বিষয়ে উপস্থাপনা। জীবন কী? এর উওর খুঁজতে হলে জানতে হবে কোয়ান্টাম পার্টিকেল সম্পর্কে। মূলত আমাদের চারপাশে ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বড় সব জিনিসই একটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রিদমিক ছন্দের অংশ!

জাতির এই দুর্যোগ মুহূর্তে কিছু কথা বলতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এদেশকে পরিচালনা করছেন। সেক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ও কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আইসিটি মন্ত্রণালয়, আইসিটি বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সকলেই আমরা একতাবদ্ধভাবে কাজ করছি।

আপনারা কেউ গুজব রটাবেন না। গুজবে কান দেবেন না। আপনারা আত্ম মনোবল রাখবেন। আমরা পরবর্তীতে এগিয়ে যাবো। বাংলাদেশ এখানে থেমে থাকবে না। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। আমরা অপারেজ হয়ে পৃথিবীতে এগিয়ে যাবে। এই দেশকে তরুণেরাই গড়ে তুলবেন। আমাদের জাতি একটি ডেমোক্রেটিক ডিভিডেন্টের সুবর্ণ সময়ে আছে। আমাদের আট কোটি লোকের বয়স ১৫-৩৫ বছরের। আমরা একটি নিশ্চয়ই একটি সফল জাতিতে পরিণত হব।

স্ট্যার্টআপ বাংলাদেশ যেটা করছে- তারা উদ্ভাবনের বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে। আপনারাও (শিক্ষর্থী-গবেষক-এন্টাপ্রেনার) উদ্ভাবনের দিকে নজর দেবেন। এখন সময়টা যেটা পাচ্ছেন তা কাজে লাগাতে পারেন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মনে হলে বই পড়ুন, কিছু উদ্ভাবনী কাজ করুন যা ভালো লাগে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলুন। সরকার যেসব বিধি নিষেধ দিয়েছে তা মেনে চলুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলোকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেসব স্বাস্থ্যবিধি দিয়েছে তা মেনে চলুন। ঘরে থাকুন, ঘরে থাকাটাই এখন যুদ্ধ। সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।

আমাদের শৃঙ্খলাবোধ ও শিষ্টাচার থাকতে হবে। পাশাপাশি দৃঢ় মনোবল, সংকল্পবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের সহমমির্মতা, মানবিকতা এবং সহযোগিতার মানসিকতায় থাকতে হবে। একতার বিকল্প নেই। সরকারের প্রতি আমাদের আস্থা অবিচল থাকতে হবে।

দুর্যোগে সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা কখনও ভালো কিছু দিতে পারবে না। আমাদের সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতৃত্ব পেয়েছিলাম। সেই সঙ্গে এখন তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্ব পাচ্ছি। আমাদের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেটা মনে রেখেই আমাদের সবকিছু মেনে নিতে হবে। আমরা গরিব দেশ, জনবহুল দেশ। সেসব বিষয় মাথায় রেখেই আমাদের দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। আইন মেনে চলতে হবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বিপন্ন করে যু্দ্ধ করে স্বাধীন করেছিলেন এই দেশ। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকেই নিজেদের জীবন বিপন্ন করে কাজ করে যাচ্ছেন।তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা বোধ থাকতে হবে। সবাই ঘরে থাকুন, শিষ্টাচার মেনে চলবেন।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমরা সবাইকে নিয়েই ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশে উন্নীত হবো। আমরা দেশের কল্যাণে আরো বেশি পড়াশোনা করবো, গবেষণা করবো। তথ্যপ্রযুক্তিকে আমরা ধারণ করবো এবং এর মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে আমরা আধুনিক বাংলাদেশে রূপান্তর করবো। সেখানে উদ্ভাবন হবে একটি চালিকাশক্তি। সেখানে সবাই এক হয়ে কাজ করবো। দেশ এগিয়ে যাবে আমরাও এগিয়ে যাবো।

ঘরে থাকুন, ভালো থাকুন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

(গত ১১ এপ্রিল ২০২০ সরকারের আইসিটি বিভাগ, স্ট্যার্ট আপ বাংলাদেশ ও এটুআই প্রকল্পের পাঁচমিশালী অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্য থেকে লেখা)

লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন(ইউজিসি) এবং
পরিচালক, বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএসসিএল)