জনস্বার্থে দুধকে ভেজালমুক্ত রাখুন

প্রকাশিতঃ 12:37 pm | June 01, 2018

:: ড. মিহির কুমার রায় ::

পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবে দুধের অবদান অনস্বীকার্য এবং পুষ্টিবিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় এটি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। বাংলাদেশে দুগ্ধ শিল্পের উপর শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ খুবই সীমিত, যদিও দেশে একটি ভেটেরিনারি ও এনিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়সহ দুটি-তিনটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় কিংবা পশু পালন অনুষদে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রমে কিছু গবেষণা পরিচালিত হয়ে থাকে। এসব গবেষণার ফল দেশের দুগ্ধ শিল্পের বিকাশে কতটুকু অবদান রাখছে তার দেখভালের দায়িত্ব সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপর ন্যস্ত। এই সংস্থাটি দেশের বিভিন্ন জেলায় বেশ কয়েকটি ডেইরি ফার্ম সরকারি কাঠামোতে পরিচালনা করছে যার মধ্যে সাভার ডেইরি ফার্ম উল্লেখযোগ্য। এই খামারের উত্পাদিত দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ঢাকা শহরে বিপণন করা হয়— যা সাভার ডেইরি হিসেবে পরিচিত। তাছাড়া মিল্ক ভিটা দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণের ও দুগ্ধসামগ্রী বিতরণের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। দেশে সরকারের পাশাপাশি আটটি বেসরকারি কোম্পানি দুগ্ধ উত্পাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। যাদের পণ্যসামগ্রী মূলত তরল দুধ, মিল্ক পাউডার, ঘি, ছানা, পনির, মাখন ইত্যাদি। দেশীয় কোম্পানিগুলো মনে করে বর্তমানে প্রচলিত দেশীয় শিল্পনীতিকে সহায়তা দিলে দেশে গ্রামেগঞ্জে অবস্থিত দুগ্ধ খামারি ও শহরকেন্দ্রিক কোম্পানিগুলো তরল কিংবা গুঁড়ো দুধের চাহিদা মেটাতে পারবে। আবার দুধ আমদানিতে বছরে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে তা যদি দেশীয় শিল্পে বিনিয়োগ করা যেত তা হলে এই শিল্পে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারত।

বিভিন্ন তথ্যে দেখা যায়, যেখানে মাথাপিছু প্রতিদিন ২৫০ মিলি লিটার দুধ পান করা প্রয়োজন সেখানে প্রাপ্তি মাত্র ৪০ মিলি মিটার। প্রাণিসম্পদ বিভাগের হিসাব মতে, যেখানে দেশে বছরে ১৪.৪৮ মিলিয়ন টন দুধের চাহিদা রয়েছে সেখানে উত্পাদন হয় মাত্র ৬.৯৭ মিলিয়ন টন এবং এই বিশাল ঘাটতি পূরণের জন্য আমদানি বাণিজ্যই প্রধান অবলম্বন। অথচ দেশে উত্পাদিত ও আমদানিকৃত দুগ্ধজাত সামগ্রীর গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর-বি) তরল দুধের উপর একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাজারে পাস্তুরিত দুধের ৭৫ শতাংশই নিরাপদ নয়।

এই গবেষণার ফলাফলে উঠে এসেছে যে দুগ্ধ খামার থেকে শুরু করে বিক্রেতা পর্যন্ত প্রতিটি বিপণন পর্যায়ে দুধ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত হচ্ছে যা কোনো মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই সকল দুধে ব্যাপক মাত্রায় কলিফর্ম, ফিক্যাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া, ই-কোলাইসহ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কেয়ার বাংলাদেশ-এর আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত একটি প্রকল্পের আওতায় দুগ্ধ শিল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে দুধের অণুজীব বিজ্ঞানগত মান যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে বগুড়া, গাইবান্ধা, নীলফামারী, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, রংপুর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার ১৮টি উপজেলায় এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয় ৪৩৮টি নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে। এছাড়াও বগুড়া ও ঢাকার বিভিন্ন দোকান থেকে বাণিজ্যিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকৃত দুধের ৯৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। গবেষণার বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রাথমিক দুগ্ধ উত্পাদনকারী পর্যায়ে ৭২ শতাংশ এবং ৫৭ শতাংশ নমুনা যথাক্রমে: কলিফর্ম ও ফিক্যাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত। এসব ব্যাকটেরিয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

পাঁচটি জেলার ১৫টি হিমাগার থেকে সংগৃহীত নমুনাগুলোতে উচ্চমাত্রার কলিফর্ম ও মলবাহিত কলিফর্ম পাওয়া গেছে। গবেষণায় আরও দেখা যায়, সরবরাহকৃত দুধে ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণা দলের প্রধান বলেছেন, বাজারে পাস্তুরিত কাঁচা দুধ ভালোভাবে ফুটিয়ে খেতে হবে। আবার দুধের প্রাথমিক উত্পাদনকারী পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে এই ধরনের দূষণের ঘটনা ঘটছে। তাই সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর দুধ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যকরভাবে দুধ দোহান, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পাস্তুরিত করার বিষয়ে যত্নবান হতে হবে। এছাড়াও দুধ নিরাপদ রাখতে উত্পাদন স্থান থেকে ভোক্তার টেবিল পর্যন্ত প্রত্যেকটি পর্যায়ে পাস্তুরিত দুধকে নিরবচ্ছিন্নভাবে শীতল রাখার পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান এই কাজটির সঙ্গে জড়িত তাদের ব্যবসায়িক নৈতিকতা এখন সবচেয়ে বড় বিষয়।

অথচ এই বিষয়টি ব্যবসায়িক মুনাফার কাছে প্রতিনিয়তই হার মানছে যা মানুষসৃষ্ট সমস্যা। কারণ পুষ্টিমানের বিচারে দুগ্ধপণ্যের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হলেও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এই স্থবিরতা কাটিয়ে উঠার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখন সরকার তাদের সপ্তম বার্ষিক পরিকল্পনায় প্রাণিসম্পদের সংখ্যা উল্লেখ করেছেন যথাক্রমে: দুগ্ধবতী গাভী ২৩.৬৪ মিলিয়ন, মহিষ ১.৪৬ মিলিয়ন এবং ছাগল ২৫.৬০ মিলিয়ন। এই সকল প্রাণী থেকে বত্সরে দুগ্ধ উত্পাদন হয় ৬.৯৭ মিলিয়ন টন যা চাহিদার তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ কম। এর প্রধান কারণ বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ও বেসরকারি খাতে উদ্যোক্তার অভাব। তাই পরিকল্পনা মেয়াদে বেশ কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হচ্ছে যেমন ডেইরিখাতে সমবায়ের উপস্থিতি, ডেইরি চাষিদের উন্নত প্রযুক্তি সরবরাহ, গবাদিপশুর খাদ্য উত্পাদন, প্রাণী স্বাস্থ্য রক্ষায় ভেটেরিনারি সেবা বৃদ্ধিকরণ ও ক্ষুদ্রকায় খামারিদের ঋণ সুবিধা প্রদানসহ বিপণন ব্যবস্থা জোরদারকরণ। এই বিষয়গুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে প্রয়োজন সরকারের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা ও বাজেট বরাদ্দ। দুগ্ধ থেকে তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর বিশাল বাজার সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে যার চাহিদা অফুরন্ত যদি তা ভেজালমুক্ত হয়। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে এই ভেজালবিরোধী অন্দোলনে শরিক হই এবং একটি পুষ্টিকর জাতি বিনির্মাণে এগিয়ে আসি। আমাদের শ্লোগান হোক ভেজালহীন পুষ্টিসমৃদ্ধ বাংলাদেশ আর দুগ্ধশিল্প হোক তার প্রথম সারির কা্লারি— সেটি কী কর্মহীনের কর্মসংস্থানে, আয় বৃদ্ধিতে ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি ও সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি, ঢাকা

email: mihir.city@gmail.com

 

কালের আলো/ওএইচ

** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে কালের আলো’র ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: KalerAlo/Facebook

Print Friendly, PDF & Email