‘জঙ্গিবাদকে দায়মুক্ত রাখতে ব্যস্ত বামপন্থীদের একটি বড় অংশ’

প্রকাশিতঃ 5:01 am | March 06, 2018

সঞ্জয় দে:

বিংশ শতকের শেষভাগে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ধরন, তৎপরতা ও কর্মপদ্ধতির সঙ্গে একবিংশ শতকের জঙ্গিবাদের সুস্পষ্ট পার্থক্য দৃশ্যমান। মোটা দাগে ২০০০ সাল পূর্ববর্তী সময়ে আফগান ফেরত যোদ্ধাদের একটি অংশের মাধ্যমে বিস্তৃত হরকাতুল জিহাদকেন্দ্রিক জঙ্গিবাদ, এমনকি ১৯৯৮ সালে জন্ম নেয় জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবির তৎপরতাও ছিল মূলত কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক।

এই সময়ের জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সাধারণভাবে দেশের মানুষের পরিষ্কার অবস্থান লক্ষ্য করা সম্ভব। এমনকি ২০০০ সাল পরবর্তী কয়েক বছরেও এই অবস্থান সুস্পষ্ট। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে জেএমবিকে রাষ্ট্রীয় মদদের পাশাপাশি ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে হামলা, এর আগে ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি সিপিবির সমাবেশে হামলা, ২০০৫ সালে সারাদেশে বোমা হামলাসহ সে সময়ে বিভিন্ন হামলার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়ার চিত্রটি মোটামুটি একই রকম।

তবে ২০০০ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ ধীরে ধীরে এক নতুন মাত্রা অর্জনের পথে অগ্রসর হয়েছে। আগের প্রায় দেড় দশক যা ছিল একেবারেই কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক (হুজি-জেএমবির প্রায় সবাই কওমি মাদ্রাসা থেকে আসা), তা ক্রমশ শহুরে তরুণদের মাঝেও ছড়াতে শুরু করে। বিশেষ করে হিজবুত তাহরিরের মতো সংগঠন বেশ শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয় ২০০৭ সালের মধ্যেই।

মজার বিষয় হলো, ২০০০ পরবর্তী সময়ে জঙ্গিবাদকে একটি বৈপ্লবিক ফর্ম হিসেবে শহরের তরুণদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করার মূল কাজটি করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন দৃশ্যত বামপন্থী অথবা বামপন্থার সঙ্গে কোনো এক সময়ে সম্পর্কিত ছিলেন এমন লোকজন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি সম্ভবত ঘটেছিল ২০০১ সালের ২৩ নভেম্বর। সেদিন ঢাকায় ‘আফগানিস্তানে পশ্চিমা আগ্রাসন ও আমাদের কর্তব্য’ শীর্ষক সভার আয়োজন করেছিল ‘আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা’। যেখানে তালেবানদের অবস্থানকে সক্রিয় সমর্থন জানান ফরহাদ মজহার। ‘ক্রুসেড, জেহাদ ও শ্রেণীসংগ্রাম’ শিরোনামে প্রবন্ধও রচনা করেন তিনি। ওই সভায় আরও কয়েকজন জিহাদকে একালে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রধান হাতিয়ারে পরিণত করার পক্ষে মত দেন, যারা দৃশ্যত ছিলেন বামপন্থী।

আমার বিবেচনায়, এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ প্রধানত যাদের কাছ থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক ছাড় ও সমর্থন পাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই বামপন্থী বা এক-কালের বামপন্থী। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হয়ত রাজনৈতিক সুবিধা নিতে এই জঙ্গিবাদকে নানাভাবে ব্যবহার করছে, কিন্তু এই জঙ্গিবাদকে দায়মুক্ত রাখার প্রধানতম দায়িত্বপালনে ব্যস্ত রয়েছে বামপন্থীদের একটি বড় অংশ। ‘জঙ্গিবাদের অভিযোগ ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়’ বা ‘নিপীড়িতের লড়াইকে অন্যায্যভাবে সন্ত্রাসের তকমা দেয়া হচ্ছে’- এমন সব প্রচারে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এখন তারাই। বামপন্থী বা সাবেক বামপন্থীদের এই তৎপরতার বড় প্রভাব হলো- তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন কাজে লাগিয়ে জঙ্গিবাদের পক্ষে দেশে এখন একটি গোষ্ঠীগত শ্রেণি প্রকাশ্য হতে পেরেছে।

পৃথিবীর আর কোথাও বামপন্থীরা নিজেদের রাজনৈতিক দায়িত্ব শিকেয় তুলে রেখে জঙ্গিবাদের মধ্যে বিপ্লবী দর্শন আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় ব্যস্ত থাকে কি না- আমার জানা নেই।

বার্তা সম্পাদক, ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশন

লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেয়া

 

কালের আলো/ওএইচ

Print Friendly, PDF & Email