শারদীয় দুর্গোৎসব : অটুট থাকুক ধর্মীয় সম্প্রীতি
প্রকাশিতঃ 5:36 pm | October 02, 2025

মাহমুদ আহমদ:
বাংলাদেশের সব ধর্মাবলম্বী মানুষ ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় পালন করে থাকে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসব। ভিন্ন ধর্মের অনুসারীরাও একে অপরের উৎসবে যোগ দেয় । আর এভাবেই বাঙালির ধর্মীয় উৎসবগুলো পরিণত হয় সর্বজনীন উৎসবে।
দেশজুড়ে মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড়ো এ ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে এখন সারাদেশে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আবহমানকাল থেকে বাংলা ভূখণ্ডে নানা জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মমতের অনুসারীরা পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে মিলেমিশে একত্রে বসবাসের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য সংহত রেখেছে। এদেশ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি। আমাদের এ দেশ অর্জিত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবার মিলিত রক্তস্রোতের বিনিময়ে।
যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে এটাই ধর্মের শিক্ষা। ধর্ম মানুষকে সম্প্রীতি ও পরমত সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। ধর্মের সঠিক জ্ঞান অর্জন ও অনুশীলন মানুষের মনে সুন্দর অনুভূতির জন্ম দেয়।
কোনো ধর্মেই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। যারা সামাজিক পরিমণ্ডলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, রক্তপাত ঘটায়, ধ্বংস যজ্ঞ এবং নৈতিকতা বর্জিত অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড চালায়, তারা কখনো শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী হতে পারে না। পবিত্র কুরআনের সুরা আল বাকারার ২৫৬ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো বলপ্রয়োগ নেই। কারণ সৎ পথ ও ভ্রান্তি উভয়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে; সুতরাং যে ব্যক্তি তাগুতকে (পুণ্যের পথে বাধা সৃষ্টিকারী বিদ্রোহী শক্তিকে) অস্বীকার করে এবং আল্লাহর ওপর ইমান আনে, সে নিশ্চয়ই এমন এক সুদৃঢ় মজবুত করে ধরেছে, যা কখনো ভাঙবার নয়।’
ধর্মীয় মত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ ‘রাব্বুল আলামিন’ জগৎসমূহের একমাত্র প্রতিপালক হিসাবে সবাইকে সমভাবে লালনপালন করে থাকেন। আস্তিক-নাস্তিক, মুসলমান-অমুসলমান সবার শেষ ঠাঁই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সৃষ্ট এ মাটিতেই হয়।
বিশ্বাসের বিরোধ থাকা সত্ত্বে সবাইকে একই মেঘের পানি দিয়ে তিনি সিঞ্চিত করেন। আস্তিক-নাস্তিক সবাইকে তার সৃষ্ট সূর্য নিজের রোদ সমভাবে প্রদান করে। এই একই কাদামাটিতে সবাই চাষাবাদ করে সমানভাবে উপকৃত হয়।
মহান আল্লাহর দয়া ও কৃপার এই সার্বজনীনতা মানুষকে এবং শিক্ষা দিচ্ছে, আমরাও যেন সবার জন্য উদারতা প্রদর্শন করি।
বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষকে সম্মান দিয়েছেন। ইসলামের ঘোরতর শত্রু ও কাফেরের লাশকেও তিনি সম্মান প্রদর্শন করেছেন এবং তার উম্মতকেও তা করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
মানবতার কবি, অসাম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল ইসলাম যিনি জাতি ধর্ম, বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাইতো তিনি লিখেছেন, গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিষ্টান।’
তিনি লিখেছিলেন ‘মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,/সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
নজরুল যে কতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তা ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধ থেকে আরো স্পষ্ট হয়। তিনি লিখেছেন: “নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ-প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এটাই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়ো, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু, তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ন হয় না। তার মন বলে, ‘আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি, আমারই মতো একজন মানুষকে।’
আসলে কে কোন ধর্মের অনুসারী তা মূল বিষয় নয়, বিষয় হলো আমরা সবাই মানুষ। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই এক জাতি। আমার ধর্মের সাথে, আমার মতের সাথে আরেক জন একমত নাও হতে পারে, তাই বলে কি তার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ রাখার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে?
ইসলাম শান্তি, সম্প্রীতি আর কল্যাণের ধর্ম। ইসলাম সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ধর্ম নয় আর আমাদের এই দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ, এখানে কোনোরূপ সন্ত্রাস ও জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত কোনো অপশক্তির স্থান নেই
চামড়ার রং, ধন-সম্পদের পরিমাণ, সামাজিক মর্যাদা, বংশ ইত্যাদির দ্বারা মানুষের মর্যাদার মূল্যায়ন হতে পারে না। মর্যাদা ও সম্মানের সঠিক মাপকাঠি হলো ব্যক্তির উচ্চমানের নৈতিক গুণাবলি এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি তার কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা। বিশ্বমানব একটি পরিবার বিশেষ। জাতি, উপজাতি, বর্ণ, বংশ ইত্যাদির বিভক্তি কেবল পরস্পরকে জানার জন্য, যাতে পরস্পরের চারিত্রিক ও মানসিক গুণাবলি দ্বারা একে অপরের উপকার সাধিত হতে পারে।
মহানবির (সা.) মৃত্যুর অল্পদিন আগে বিদায় হজের সময় বিরাট ইসলামি সমাগমকে সম্বোধন করে তিনি (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করলো। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ।’ (বায়হাকি)
এই মহান শব্দগুলো ইসলামের উচ্চতম আদর্শ ও শ্রেষ্ঠতম নীতিমালার একটি দিক উজ্জ্বলভাবে চিত্রায়িত করেছে। শতধা বিভক্ত একটি সমাজকে অত্যাধুনিক গণতন্ত্রের সমতাভিত্তিক সমাজে ঐক্যবদ্ধ করার কী অসাধারণ উদাত্ত আহ্বান।
কোনো ধর্মেই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। যারা সামাজিক পরিমণ্ডলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, রক্তপাত ঘটায়, ধ্বংস যজ্ঞ এবং নৈতিকতা বর্জিত অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড চালায়, তারা কখনো শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী হতে পারে না। পবিত্র কুরআনের সুরা আল বাকারার ২৫৬ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো বলপ্রয়োগ নেই। কারণ সৎ পথ ও ভ্রান্তি উভয়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে; সুতরাং যে ব্যক্তি তাগুতকে (পুণ্যের পথে বাধা সৃষ্টিকারী বিদ্রোহী শক্তিকে) অস্বীকার করে এবং আল্লাহর ওপর ইমান আনে, সে নিশ্চয়ই এমন এক সুদৃঢ় মজবুত করে ধরেছে, যা কখনো ভাঙবার নয়।’
আল্লাহপাকের প্রেরিত নবিগণ আল্লাহর নির্দেশে পথহারা মানুষকে হেদায়েত দিতে থাকেন। যখন তারা স্বয়ং এ শিক্ষা দেন, তখন তারা শুধু ধর্মান্তর গ্রহণের কারণে কারো প্রতি বল প্রয়োগ বা জুলুম করা কীরূপে শিক্ষা দিতে পারেন? ধর্ম কখনো অশান্তি ও রক্তপাতের উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয় নাই। কোনো ধর্ম গ্রহণ বা বর্জন করলে ইসলামে এর কোনো ধরনের শাস্তির বিধান নেই। শাস্তি দেওয়ার মালিক হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তাআলা।
বিশ্বাসের-স্বাধীনতা হচ্ছে সব মানুষের মৌলিক অধিকার। ইসলাম ধর্মের বিধান মতে ‘ধর্ম’ হচ্ছে নিজ, পছন্দের একটি বিষয়। এ ধর্ম একটি সুস্পষ্ট ও শান্তির ধর্ম।
এই ধর্ম গ্রহণের পরেও চাইলে কেউ এটা ত্যাগ করতে পারে, কোনো জোর নেই, তবে এর বিচার সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজ হাতেই রেখেছেন। ধর্মে যদি বল প্রয়োগের বিধানই থাকতো, তাহলে মহানবি (সা.) মক্কা বিজয়ের পর অমুসলমানদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য বাধ্য করতেন এবং মক্কায় বসবাসের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নাই! এতে প্রমাণিত হয় যে, ধর্মের জন্য বল প্রয়োগ ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলামের আদর্শ হলো শত্রুর সাথেও বন্ধুসুলভ আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।
আমাদের এই দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ, এখানে কোনোরূপ সন্ত্রাস ও জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত কোনো অপশক্তির স্থান নেই। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মের সাথ আমাদের প্রত্যাশা।
সনাতন ধর্মাবলম্বী সকলের প্রতি রইল শারদীয় দুর্গোৎসবের শুভেচ্ছা।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।