রাজধানীর ‘পথের কাঁটা’ ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইক 

প্রকাশিতঃ 9:48 am | October 02, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

রাজধানীর প্রায় সব সড়কে জুড়ে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইক। প্রকৃত অর্থেই নগরবাসীর এই যান ‘পথের কাঁটা’। যার নেই কোনো হার্ড ব্রেক কিংবা নির্দিষ্ট গতিসীমা। যার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই চালাচ্ছেন। নেই নিয়ম নীতির তোয়াক্কা। মহল্লার ছোট-বড় গলি থেকে শুরু করে, সড়ক থেকে ফ্লাইওভার পর্যন্ত, সকল জায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই ব্যাটারি রিকশা।

বেসরকারি একটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ঢাকার রাস্তায় বেপরোয়া হয়ে ওঠা এই যানের সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। এলাকার অলিগলি থেকে শুরু করে সড়ক-মহাসড়কেও দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কাঠামোগত ত্রুটিযুক্ত এই বাহন। বাড়ছে প্রাণহানি ও পঙ্গুত্ব। অনেকটা অদৃশ্য কারণে প্রশাসনও যেন নীরব ভূমিকায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর গণপরিবহনকে সুব্যবস্থাপনায় আনাই একমাত্র সমাধান।

জানা যায়, ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশই ব্যাটারিচালিত রিকশা দুর্ঘটনার শিকার। ২০১৪, ২০১৭ ও ২০২১ সালে ৩ দফা হাইকোর্ট ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ ও আমদানি নিষিদ্ধ করলেও এসবের সংখ্যা না কমে বরং বাড়তে থাকে। সবশেষ গত বছর নভেম্বরে হাইকোর্ট আবারও তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারি রিকশা চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন। তবে চালকদের বিক্ষোভের মুখে পিছু হটে সরকার। দেশে কতসংখ্যক ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্যও সরকারের কাছে নেই। বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের তথ্যানুযায়ী, এর সংখ্যা ৪৮ থেকে ৫০ লাখ। কোনো নীতিমালা ও নিবন্ধন না থাকায় সহজেই এই বাহন আমদানি, বিক্রি ও চলাচল আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে বলে মত বিশেষজ্ঞেদের।

ট্রাফিক পুলিশের তথ্য বলছে, ঢাকায় বৈধ অনুমোদনের চেয়ে বহু গুণ বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। অতিরিক্ত সংখ্যা ও বেপরোয়া গতি যানজট বাড়াচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে গণপরিবহন ব্যবস্থা। রাস্তাঘাটে এদের দখলদারি পথচারীদের জন্যও চরম ভোগান্তি তৈরি করেছে। শুধু দুর্ঘটনা নয়, এই যান ছিনতাইকারীদের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে, যা নগরীর নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ফলে রাজধানীর বুকে এই ত্রি-চক্র যান কার্যত ‘বিষফোঁড়া’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘পঙ্গপালের মতো এসব অটোরিকশা রাস্তায় নামছে। এতে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিছুদিন পর এগুলো অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’ যন্ত্রের সাহায্যে চলে এমন যানবাহনের অনুমোদন দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ, বিআরটিএর। একই সঙ্গে সড়কে নিরাপত্তা ও অবৈধ যানবাহন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে সংস্থাটি। তবে কেন ব্যাটারি চালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এমন প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর দিতে পারেনি সংস্থাটি।

পরিবেশ ও বিদ্যুৎ খাতেও এই যান বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনছে। ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোয় ব্যবহৃত নিম্নমানের লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি চার্জ দিতে প্রতিটি যান ৪ থেকে ৫ কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ খরচ করে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন এই খাতে নষ্ট হচ্ছে অন্তত ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। অবৈধ সংযোগ থেকে চার্জ নেয়ার কারণে বাড়ছে লোডশেডিং, ভোগান্তিতে পড়ছেন বৈধ গ্রাহকরা। এসব যান তৈরির যন্ত্রাংশ আমদানি ও উৎপাদন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা, যাতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিশ্চিত হয়।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা আরও উদ্বেগজনক। ব্যবহৃত লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি যথাযথভাবে রিসাইক্লিং না করেই ফেলে দেওয়ায় মারাত্মক সীসা দূষণ ঘটছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, সীসা মানবদেহের স্নায়ুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, যা দীর্ঘমেয়াদে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত সমন্বিত নীতি প্রণয়ন না করলে ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকা শহরের পরিবহন ব্যবস্থাকে অচল করে দিতে পারে। তাই অবিলম্বে এসব যান নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, নইলে নগরবাসীর নিরাপত্তা ও পরিবেশের জন্য এর মাশুল হবে ভয়াবহ।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, তাদের জরিপ অনুযায়ী শুধু ২০২৪ সালে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যান দুর্ঘটনায় ৪৫৭ জন নিহত এবং ১ হাজার দুইশজনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ২৫টি দুর্ঘটনা ঘটছে ব্যাটারিচালিত বাহনের কারণে।

যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজি বাইক নিয়ে আসলে সবসময় রাজনীতি হয়েছে। সরকারের উচিত অতি দ্রুত কিছু নীতিমালা তৈরি করা। এগুলোকে কী পরিমাণে নিবন্ধন দেয়া যায় তা সরকারকে ঠিক করতে হবে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাটারি রিকশার পার্টসগুলোর আমদানি বন্ধ করতে হবে।’

কালের আলো/এমএএইচ/এইচএন