প্রবাসীদের প্রক্সি ভোটে বেঁকে বসেছে রাজনৈতিক দলগুলো

প্রকাশিতঃ 7:12 pm | April 29, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

প্রবাসীদের ভোট নেওয়ার সম্ভাব্য তিন পদ্ধতির মধ্যে ‘প্রক্সি ভোটিং’ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বেশ আগ্রহ থাকলেও রীতিমতো বেঁকে বসেছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। তাঁরা এই পদ্ধতিতে ‘ঝুঁকি’ বা ‘ত্রুটি’ থাকার কথা বলেছে। প্রক্সি পদ্ধতির সম্ভাব্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। একই সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও এই পদ্ধতিতে জালিয়াতির আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ‘বিশ্বাসহীনতা’র বিষয়টি জানিয়েছে। যদিও তাঁরা প্রবাসীদের ভোটের ব্যবস্থা করতে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। দলগুলো বলছে, ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হলে প্রযুক্তি, নিরাপত্তা ও জনগণের আস্থার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে। অধিকাংশ দল এখনো দলীয় ফোরামে আলোচনা করে চূড়ান্ত মতো দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।

প্রবাসীদের ভোট গ্রহণের সম্ভাব্য পদ্ধতি নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) নির্বাচন কমিশনের সেমিনারে দলগুলো নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে। এদিন সেমিনারে নানা পরামর্শও আসে। তবে শেষমেশ কোন পদ্ধতিতে প্রবাসীদের ভোট হতে পারে, সে মতামত দলগুলোকে ১৫ মের মধ্যে লিখিত আকারে পাঠাতে বলেছে ইসি।

সূত্র জানায়, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘ভোটিং সিস্টেম উন্নয়ন’ শিরোনামে সেমিনারটি হয় আগারগাঁওয়ে; নির্বাচন ভবনের মিলনায়তনে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘ছোট পরিসরে’ হলেও পোস্টাল ব্যালট, অনলাইন ভোটিং ও প্রক্সি ভোটিংয়ের মধ্য থেকে যেকোনো একটি পদ্ধতি চালু করতে চায় ইসি। সেমিনারে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ অন্তত ২১টি দলের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে। সেমিনারের শুরুতে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ ভোট পদ্ধতি তুলে ধরেন। প্রবাসীদের ভোট পদ্ধতি নিয়ে ১৫ মে এর মধ্যে দল ও অংশীজনের মতামত লিখিত আকারে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

এদিন বিকেলে সেমিনারের সমাপনী বক্তব্য রাখেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আপনারা সকাল থেকে আলোচনা করেছেন, অত্যন্ত মূল্যবান মতামত দিয়েছেন। আমরা অ্যাপ্রোপিয়েট পদ্ধতি বাছাইয়ের চেষ্টা করছি। ইনশাআল্লাহ আপনাদের মতামতকে গুরুত্ব দেব।’ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আবার দলেগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হবে মন্তব্য করে সিইসি বলেন, ‘রাজনৈতিক দল হচ্ছে আমাদের প্রধান অংশীজন। ভবিষ্যতে আপনাদের দাওয়াত দেব; আপনারা আসবেন। আপনাদের মতামতের জন্য এবং সর্বোপরি নির্বাচনের জন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই।’

এর আগে সকালে সেমিনারের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে আগামী নির্বাচনে ছোট পরিসরে হলেও প্রবাসীদের ভোটিং চালু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন সিইসি। এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা পরবর্তী নির্বাচনে অন্তত শুরু করতে চাই; অন্তত যাত্রা শুরু হোক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ শুরু করে আবার এগোতে পারেনি। প্রক্সি ভোট অনেক দেশ চালু করেছে, অনেক দেশ চালু করতে পারেনি। আমরা চালু করতে চাই, অন্তত সীমিত পরিসরে শুরু করতে চাই।’ প্রবাসীদের ভোট পদ্ধতি নির্ধারণে রাজনৈতিক দলের সমর্থন না পেলে ইসির সব উদ্যোগ ‘বৃথা’ যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

‘প্রক্সি ভোটিং’ নিয়ে ‘ঝুঁকি’, ‘ত্রুটি’ ও জালিয়াতির আশঙ্কা
বিএনপির পক্ষে অবস্থান তুলে ধরেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। দলটি প্রবাসীদের ভোটের ব্যবস্থা করার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে তিনটি পদ্ধতির বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে ১৫ মে মধ্যে মতামত দেবে। নজরুল ইসলাম খান বলেন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে কেবল জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বিবেচনায় নিলে হবে না, এনআইডির পাশাপাশি পাসপোর্টও বিবেচনায় নিতে হবে। কেননা অনেকের এনআইডি নেই।

এ বিএনপি নেতা বলেন, ‘২০১৪ সালে ইসি যখন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন আমরা প্রবাসীদের ভোটাধিকারের সুযোগের প্রস্তাব করেছিলাম। ২০১৭ সালের ভিশন ২০৩০, ২০২২ সালের ২৭ দফাতেও প্রবাসীর ভেটের কথা বলেছি। ২০২৩ সালে রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফাতেও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। প্রবাসীদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার উদ্যোগের প্রতি বিএনপির পূর্ণ সমর্থন আছে।’ ইসির সেমিনারে তিনটি পদ্ধতির বিস্তারিত দলীয় ফোরামে আলোচনা করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেমিনারে প্রবাসীদের ভোটিংয়ের তিন প্রস্তাব (অনলাইন, প্রক্সি ভোটিং ও পোস্টাল ব্যালট) উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা আমাদের দলে আলোচনা করে মতামত দেব।’ তাঁর ভাষ্য হচ্ছেÑ ‘দুনিয়ায় কোনো সিস্টেমই ফুল প্রুফ না। ফুল প্রুফ হলে সংস্কার, বিপ্লবের প্রয়োজন হয় না। আমরা বিবেচনা করব, সবচেয়ে যেটা সহজ, বোধগম্য হবে, সবচেয়ে যেটা গ্রহণযোগ্য হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে, যেটা সবচেয়ে সাশ্রয়ী হবে, সেই প্রক্রিয়ার প্রতি আমরা সম্মত হতে পারব বলে আশা করি।’

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য জসিম উদ্দিন সরকার বলেন, ‘উদ্যোগ নিলেই অর্ধেক কাজ হয়ে যায়। এটি ভালো উদ্যোগ। ‘ট্রায়াল অ্যান্ড ইররের’ মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।’ দলীয় ফোরামে পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে মতামত জানানোর কথাও তুলে ধরেন তিনি।

জামাতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘আমরা ইসির সঙ্গে বৈঠকে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টি এনেছিলাম। ইসি সে উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি হয়েছে গত ১৫ বছরে। ইসির প্রতি ট্রাস্ট অ্যান্ড কনফিডেন্স হারিয়ে ফেলেছে।’

প্রক্সি ভোটের ত্রুটির বিষয়ে এই নেতা বলেন, ‘এক্স একজনকে পছন্দ করে, ওয়াই আরেকজনকে পছন্দ করে। তাহলে এক্স এর প্রক্সি যদি ওয়াইকে দেওয়া হয়, তাহলে ভোটারের রায়ের সঠিক প্রতিফলন হবে না। তবে দলীয় ফোরামে আলোচনার পরই পরবর্তীতে মতামত দেওয়া হবে। “আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হবে। কোনো অবস্থাতেই সিস্টেমকে ডেসট্রয় করা যাবে না।’

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের পর প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার আগ্রহ বেশ দেখছি। ইসির কাছে আমাদের প্রত্যাশা, পরিপূর্ণ এফোর্ট দিয়ে যেন তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারে। প্রক্সি ভোট হলে কোথাও কোথাও বেশি ভোট আসতে পারে। সেক্ষেত্রে এটা একটা থ্রেট হতে পারে। আমরা দলীয় ফোরামের আলোচনা করে ইসিকে মতামত জানাব।’ তাঁর কাছে, প্রক্সি ভোটের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘ট্রাস্ট’। এমনটি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা বজায় রাখতে হবে। সবার যেন ট্রাস্ট থাকে, সেটা অনলাইন হোক, আর পোস্টাল হোক। প্রক্সি নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। সেটা দলীয় ফোরামের আলোচনা করে জানাব।’

প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠিত করতে ‘ডায়াস্পোরা অ্যালায়েন্স’ নামে একটি স্বতন্ত্র সংগঠন তৈরির প্রস্তুতি কমিটি করেছে এনসিপি। এই কমিটির সদস্য এহতেশামুল হক বলেন, ‘প্রবাসে রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণবিধির ব্যাপারে ইসিকে একটা দৃঢ় অবস্থানে আসতে হবে। প্রবাসীরা আচরণবিধি প্র্যাকটিসে যদি আরেকটু সভ্য হতে পারি, তাহলে ইসির জন্য কাজ করা আরেকটু সহজ হবে।’

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘দলীয় ফোরামে আলোচনা করে মতামত জানাব। প্রক্সি ভোটে দেখেছি যেটা, আমার মা একটি দলকে ভোট দেয়; আমার বাবা আরেকটি দলকে ভোট দেয়। এ ক্ষেত্রে প্রক্সির মাধ্যমে কী করে সিকিউরিটি নিশ্চিত করা যায়, সেটা ভেবে দেখতে হবে।’

এবি পার্টির শ্যাডো অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি আব্বাস ইসলাম খান বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের এনআইডি আছে। কিন্তু পশ্চিমা দেশে কিন্তু বেশির ভাগেরই পাসপোর্ট আছে। তারা মিশনে গিয়ে কেন এনআইডি নেবে। কাজেই পাসপোর্টও যেন অপশন রাখা হয়।’ তিনি বলেন, ‘এনআইডির ডেটার নিরাপত্তা দিতে পারিনি। তাই অনলাইন ভোটিংয়ে পাবলিক ট্রাস্ট নিয়ে আসতে হবে। অনলাইনে যেহেতু হ্যাক করা যায়, সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার এলে কী হবে, সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। এছাড়া প্রক্সি ভোট বাংলাদেশের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ। উন্নত বিশ্ব যেখানে পারছে না, আমাদের নাগরিকরা যেখানে সত্যিকার নাগরিক হতে পারেনি, সেখানে দলগুলো কিন্তু ফাঁকফোকর বের করে ফেলবে।’

কালের আলো/আরআই/এমএসএএকে