ভেতরে-বাইরে যেমন রওশন এরশাদ

প্রকাশিতঃ 12:28 pm | February 19, 2018

অ্যাক্টিং এডিটর, কালের আলো:

এমপি মানেই থানার ওসি ‘পছন্দ’ করে আনবেন। গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য দাপ্তরিক পদগুলোতেও থাকবে তাঁর ‘মাইম্যান’- রাজনীতিতে এমন রেওয়াজ চলে আসছে অনেক দিন। এমপিদের এলাকায় উপস্থিতি মানেই নড়েচড়ে ওঠবে শহর, গ্রাম! আবার এমপি ছুটবেন, ‘হন্তদন্ত’ হয়ে তাঁর পিছু পিছু ছুটবে কর্মীরা। বড় বড় শোডাউন। প্রকম্পিত রাজপথ।

বেঁধে যাবে হুলস্থুল কর্মকান্ড। চলমান জামানায় এমন রাজনৈতিক ধারার বাইরের মানুষ বেগম রওশন এরশাদ। বলা হয়, অপরাজনীতি ও দাম্ভিকতার যুগেও একেবারেই উল্টোরথে জাতীয় সংসদের এ বিরোধী দলীয় নেতা।

হাইব্রিড, আনাড়িদের নিয়ে অসহনীয় বাড়াবাড়ির রাজনীতিও ধাঁচে নেই তাঁর। জাতীয় রাজনীতির এ চেনা মুখ দুই দুইটি বড় পদে থেকেও নিজেকে ‘শো অন’ করেন না। প্রভাবও দেখান না নুন্যতম। বিষয়গুলো বেশ অবিশ্বাস্য ঠেকলেও ভেতরে-বাইরে এমনই একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ তিনি।

দলীয় নেতা-কর্মী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছাড়াও তাকে চিনেন এবং জানেন এমন মানুষ মাত্রই অবনত মস্তকে স্বীকার করবেন দম্ভ বা অহংকার তাঁর দীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে কলঙ্ক কালিমা লেপন করতে পারেনি। কয়েক যুগের পথচলার পরেও দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি’র উর্ধ্বেই রেখেছেন নিজেকে।

নিজের চারপাশে ওঠতে দেননি কাঁচের দেয়াল। করেননি ‘সিন্ডিকেট’ গড়ার রাজনীতি। স্তাবকদের ভিড়ে আড়াল হননি। নিজের খোলা চোখেই সব দেখেন। কঠিন পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। দেশের রাজনীতির ইতিহাসে গণতন্ত্র ও দেশের ধারাবাহিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় তাঁর ভূমিকা ও অবদান জাতি মনে রাখবে, গর্ব করেই বলছিলেন জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা।

মর্যাদাপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসন থেকেই বিএনপিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন রওশন এরশাদ। ইতোপূর্বে নিজ এলাকার এ আসনটিতে সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি।

গত নির্বাচন বিএনপি বর্জনের পর রাজনীতির চরম এক দুর্যোগময় মুহুর্তে ‘ত্রাতা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হন বর্তমান এ বিরোধী দলীয় নেত্রী।

দেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার কারিগরও বলা হচ্ছে তাকে। জাতীয় রাজনীতিতে ময়মনসিংহের কন্যার সমকালীন ভূমিকা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও যুক্তিনির্ভর বক্তব্যেরও জুড়ি নেই। নব্বইয়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে পটপরিবর্তনের পর দু:সহ দিনগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজনীতিতে বরাবরই পথ হাঁটেন পোড় খাওয়া নেত্রী।

একজন সংসদ সদস্য হিসেবে এলাকার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ময়মনসিংহবাসীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ‘ময়মনসিংহ বিভাগ’ তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাজি করিয়েছেন। বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্ব নিয়েই ময়মনসিংহবাসীকে বিভাগের দাবি আদায় করে দিয়েছেন।

তাঁর এ ঐতিহাসিক ‘উপহার’ পূর্ণতা দিয়েছে এ অঞ্চলের মানুষজনের চার দশকের তীব্র আকাঙ্খাকে। বিভাগের দাবি পূরণ করায় রওশন এরশাদ বরাবরই প্রধানমন্ত্রী’র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ‘আমি জীবদ্দশায় ময়মনসিংহ বিভাগ দেখে যেতে চেয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছিলেন। তিনি কথা রেখেছেন।’

দলীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন, প্রথমবারের মতো বিরোধী দলীয় নেতা হয়ে ময়মনসিংহকে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে অন্যরকম এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন রওশন এরশাদ। জাতীয় পার্টির শাসনামলে স্বামী এইচ.এম.এরশাদের কাছ থেকে বিভাগ দাবি পূরণের ব্যবস্থা করলেও শেষ পর্যন্ত ভাগ্য বিড়ম্বনাই মেনে নিতে হয় এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের।

জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের ভাষ্যে-দিনের পর দিন ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষকে বিভাগের মতো অনন্য এক উপহার দিয়ে বেগম রওশন এরশাদ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনে ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে তাঁর পক্ষেই রায় নিতে সক্ষম হবেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘গাঁটছড়া’ থাকলে আসনটিতে মনোনয়ন তাঁর, এমন বিশ্বাস দলীয় নেতা-কর্মীদের।

ময়মনসিংহ বিভাগের ‘রূপকার’ রওশন এরশাদের কাছে এখন ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দাদের একটি প্রত্যাশার কথা জোরেশোরেই উচ্চারিত হচ্ছে। প্রয়োজনীয় টাকা বরাদ্দ না পাওয়ায় আটকে আছে ময়মনসিংহ বিভাগের নতুন শহর প্রতিষ্ঠার জন্য জমি অধিগ্রহণ কাজ।

বিভাগ প্রতিষ্ঠার দুই বছর পেরিয়ে গেলেও ব্রক্ষপুত্র নদের ওপারে নতুন বিভাগীয় শহর প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ, দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন ব্যয়ের জন্য মেলেনি ৬ হাজার ৩’শ কোটি টাকা’র বরাদ্দ। এ জমি অধিগ্রহণের বিরোধীতা করায় বিষয়টিরও কোন সুরাহা হয়নি।

প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ চেয়ে জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মাস সাতেক আগে অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিলেও কোন সাড়া মেলেনি। বিভাগের জমি অধিগ্রহণে এ দীর্ঘসূত্রতা স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্রমশ আশাহত করছে। অচিরেই মহান জাতীয় সংসদে গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি বিরোধী দলীয় নেতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী’র দৃষ্টিতে আনবেন এবং অর্থ ছাড় করাতে সক্ষম হবেন এমন প্রত্যাশা এখানকার বাসিন্দাদের।

দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে কার্যকর বিরোধী দলের কৃতিত্বও রয়েছে রওশন এরশাদের সাফল্যের ঝুলিতে। তাঁর নেতৃত্বেই গঠনমূলক বিরোধী দলের ‘রোল প্লে’ করছে জাতীয় পার্টি। সরকারের ভাল কাজে দলটি যেমন প্রশংসা করেছে তেমনি সমালোচনা করতেও ছাড়েননি।

সংসদে দাঁড়িয়ে গত রোববারও (১৮ ফেব্রুয়ারি) অর্থমন্ত্রীকে ধুঁয়ে দিয়েছেন জাতীয় পার্টির দুই নেতা জিয়াউদ্দিন বাবলু ও কাজী ফিরোজ রশিদ। সংসদ বর্জন ও অযৌক্তিক ওয়াকআউট না করেও সংসদের ভেতরে জনগণের সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন বিরোধী দলীয় নেতা।

সংসদকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতেও প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। রওশন এরশাদ বিশ্বাস করেন সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে-সরকার ও বিরোধী দল পারস্পারিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে দেশকে সামনে এগিয়ে নেবে। সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।

অনেক ইস্যুতে সরকার বিরোধী দলের সঙ্গে সহমতও পোষণ করেছে, এটিও বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে রওশন এরশাদের রাজনৈতিক কারিশমা বলেও মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।

 

কালের আলো/এএ/ওএইচ

Print Friendly, PDF & Email