আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে পোশাক শিল্পের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ ও নির্বিঘ্নে দুর্গাপূজা উদযাপনে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
প্রকাশিতঃ 8:43 pm | October 01, 2024
আব্দুল হামিদ/ইয়াছিন আরাফাত, কালের আলো:
আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা কমিটির এই বৈঠকে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে করণীয় নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি পোশাক শিল্পে অস্থিরতা দমন ও নির্বিঘ্নে দুর্গাপূজা উদযাপনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভালো না হলেও সন্তোষজনক রয়েছে বলে বৈঠক শেষে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
পরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বিশেষ গুরুত্ব পায় পোশাক শিল্পে চলমান অস্থিরতার বিষয়টিও। বিশেষ করে গুজব ছড়িয়ে গত সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) আশুলিয়ায় সহিংসতা ঘটানো হয়েছে বলে দাবি করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেছেন, সেখানে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের মধ্যে ঢুকে অনুপ্রবেশকারীরা গুলি চালিয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটিতে পার্বত্য জেলাসমূহে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং সশস্ত্র গ্রুপের অপতৎপরতা রোধে করণীয়; সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও জঙ্গি প্রতিরোধ, নির্মূল ও নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ; অস্ত্র জমা ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনা; বিভিন্ন মাজার-দরগার নিরাপত্তা বিধান; মাদকের অপব্যবহার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; গার্মেন্টস কারখানা, ওষুধ শিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির তৎপরতা রোধে করণীয়; মিয়ানমার সীমান্ত ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
এ সময় আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এবারের পূজা সবচেয়ে নির্বিঘ্ন ও ভালো হবে
বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘আজ ছিল আইনশৃঙ্খলা উপদেষ্টা কমিটির দ্বিতীয় সভা। আসন্ন দুর্গাপূজা যাতে নির্বিঘ্ন হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আশা করছি, এবারের পূজা সবচেয়ে নির্বিঘ্ন হবে, সবচেয়ে ভালো হবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আশুলিয়ায় শিল্পকারখানায় যে ঝামেলা চলছে, তা নিয়েও কথা বলেছি। অস্ত্র উদ্ধার অভিযান ও মাদকের ব্যবহার রোধ নিয়েও বিস্তারিত কথা বলেছি। মিয়ানমার সীমান্ত নিয়েও আমরা কথা বলেছি।’
তিনি বলেন, ‘পূজা নির্বিঘ্ন করতে যা যা পদক্ষেপ নেওয়ার, সবই নেব। আশা করব এবারের পূজা আগের বারের চেয়ে অনেক ভালো হবে। এজন্য সবার সাহায্য ও সহযোগিতা দরকার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি যেটা হয়েছে, সেটা সন্তোষজনক। যত দিন যাবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।
উপদেষ্টা বলেন, এ ছাড়া বিভিন্ন মাজার ও দরগায় কীভাবে নিরাপত্তা দেওয়া যায়, তা নিয়ে বৈঠকে আমরা আলোচনা করেছি। বিশেষ করে গার্মেন্টস খাত নিয়ে আমরা কথা বলেছি।’
পূজার ছুটি তিনদিন করার দাবি নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না– জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমাদের এখানে কোনো আলোচনা হয়নি। এমনকি পূজার তিনদিন ছুটি করা নিয়ে আমি কোনোদিন বলিনি। এটা আমার পারভিউয়ের (আওতায়) মধ্যে পড়ে না।’
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ে নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি হওয়ার পর ইউপিডিএফ হাতিয়ার সমর্পণ করেনি। জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) কেবল হাতিয়ার সমর্পণ করেছিল। ইউপিডিএফ ও জেএসএসের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঝামেলা আছে। অন্য যারা আছে, তাদের মধ্যেও ঝামেলা আছে। তারা মিলেমিশে কীভাবে থাকতে পারে, সেটা নিয়ে ব্যবস্থা করতে হবে।’
উপদেষ্টা বলেন, ‘অনেক সময় তারা বাইরে থেকেও কিছু অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। ওটা যাতে না পায়, সেটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে।’ এক উপদেষ্টা বলেছিলেন দুই মাসের মধ্যে পুলিশ বাহিনী সংস্কার করা হবে– এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘পুলিশ সংস্কারের কাজ ১ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়ার কথা। সংস্কারের কাজটা আমি করছি না, এজন্য আলাদা কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। ওই কমিটি কাজটি করবে। তারা আমাদের কাছে প্রতিবেদন দেবেন, সেই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সংস্কার হবে।’
পুলিশের যেসব সদস্য এখনও যোগদান করেননি তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘যারা এখনও যোগদান করেনি তাদের আমরা পুলিশ বলব না। তাদের ক্রিমিনাল বলব। আমরা আনসার, পুলিশ ও বিজিবি নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দু’একদিনের মধ্যে আপনারা সাব-ইন্সপেক্টর নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি পাবেন। কতজন পুলিশ এখনও কাজে যোগ দেয়নি– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৮৭ জনের মতো ছিল। পরে মনে হয় আর কেউ যোগদান করেননি। যারা যোগ দেননি, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের আমরা পুলিশ বলব না, তাদের আমরা অপরাধী হিসেবে গণ্য করব।’
আশুলিয়ায় সহিংসতা, গুলি করেছে ‘অনুপ্রবেশকারীরা’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে আশুলিয়ার ঘটনা নিয়ে কথা বলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। গুজব ছড়িয়ে গত সোমবার ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের আশুলিয়ার জিরাবো এলাকার মণ্ডল গ্রুপের কারখানার সামনে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলে জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নারী শ্রমিককে ধর্ষণ করা হয়েছে, দু’জন শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে, এ ধরনের গুজব ছড়ানো হয়। এই গুজব থেকেই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে অবস্থান নেওয়া অনুপ্রবেশকারীরা গুলিও ছুড়েছে।’
এর আগে ওই সহিসংতায় টঙ্গাবাড়ি এলাকার ম্যাংগো টেক্স লিমিটেডের সুইং অপারেটর কাউসার হোসেন খাঁন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এছাড়া গুলিবিদ্ধ ও আহত হন আরো করেকজন শ্রমিক। শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা বলেন, ‘ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে একটি গুজবকে কেন্দ্র করে। পরবর্তীতে শ্রমিকদের মধ্য থেকে অনুপ্রবেশকারীরা গুলি ছোড়ে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৩ জন আহত হন। এই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়িও ভাঙচুর করা হয়।’
উপদেষ্টা বলেন, ‘পুরো ঘটনায় পরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদেরকে উস্কি দিয়ে রাস্তায় নামানো হয়েছে। এরপরই পরিস্থিতির অবনতি হয়।’ উসকানিদাতা এবং অনুপ্রবেশকারীদেরকে চিহ্নিত করার কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
আশুলিয়ায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে জানিয়ে শ্রম উপদেষ্টা বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া আছে। একই সাথে শ্রমিক এবং মালিকদের মধ্যে মডারেটর হিসেবে কাজ করার জন্য বলা হয়েছে।’ নিহত শ্রমিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, আহত শ্রমিকদেরকেও সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।
মঙ্গলবারও বাইপাইল এলাকায় বেশ কিছু শ্রমিক বেতন ভাতার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দুই তিনটি গার্মেন্টসের শ্রমিকরা বেতন না পেয়ে রাস্তায় নেমেছে। এসব গার্মেন্টসের মালিকরা এখন পলাতক রয়েছে। যেসব মালিক প্রতিশ্রুতি দিয়েও শ্রমিকদের দাবিদাওয়া বাস্তবায়নের ব্যাপারে কাজ করছেন না, তাদের ব্যাপারে আগেও বলেছি আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা।’ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান এ উপদেষ্টা।
কালের আলো/এমএএএমকে