তবুও শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ থামছে না
প্রকাশিতঃ 12:03 am | October 01, 2024
কালের আলো রিপোর্ট:
থেমেও থামছে না সাভারের আশুলিয়া ও গাজীপুরের শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ। দাবি মেনে নেওয়ার পরও আন্দোলন-ভাঙচুর অব্যাহত রয়েছে। অথচ গত ২৫ সেপ্টেম্বর শিল্পাঞ্চলের কর্মপরিবেশ স্বাভাবিক হয়েছিল। কিন্তু নতুন করে আবার নৈরাজ্য শুরু হওয়ায় দানা বাঁধছে সন্দেহ-রহস্য। গতকাল সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল ও ডিওএইচএস পয়েন্টে সড়ক অবরোধ করলে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে এক শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটেছে। বিচ্ছিন্নভাবে নয় সামগ্রিকভাবে শ্রমিকদের দাবি নিয়ে কাজ না করলে চলমান অসন্তোষ কমানো কঠিন হবে বলেও মনে করছেন অনেকেই।
পোশাকখাতের সংশ্লিষ্টরা এমন অসন্তোষের কিনারা করতে একাধিক বিষয়ে নজর দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন। তাদের ধারণা, এই জায়গাগুলোতে সরকার যদি নজর দেয় তাহলে বের হতে পারে সম্ভাব্য সমাধান।
সূত্র বলছে, পোশাক খাতের কর্মীরা কাজ করতে ইচ্ছুক। কিন্তু এক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। তারা হুমকি দিচ্ছে, মারধর করছে। এরা স্থানীয় দুর্বৃত্ত এবং বেশির ভাগই ঝুট ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটা করছে। দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এ খাত শান্ত হবে না। অথচ কিছু নতুন শ্রমিকের মাধ্যমে অস্থিরতা উসকে দেওয়া হচ্ছে বারবার।
কোন কোন কর্মী চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছে বা চাকরি পেতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে কেউ সুবিধা পাচ্ছে না, তারা শ্রমিক অসন্তোষের নামে অরাজকতা তৈরি করছে। যদিও কারখানার মালিকদের দাবি, একটি স্বার্থান্বেষী মহল শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করার জন্য নৈরাজ্য সৃষ্টিতে উৎসাহিত করছে। একজন শ্রমিককে বরখাস্ত করা হলে সে তার বেতনের চেয়ে বেশি পাবে। একই সঙ্গে ক্রেতাদের চাপের মুখে কারখানা মালিক ও বিজিএমইএ বর্তমান অবস্থা নিয়ে চরম বাজে অবস্থা পার করছে। আকাশপথে পণ্য পাঠানোর জন্য রপ্তানিকারকদের ছাড় ও অতিরিক্ত চার্জ দিতে হয়। ফলে কমে লাভ।
জানা যায়, গত ২৪ সেপ্টেম্বর নবীনগর-আশুলিয়া-আব্দুল্লাহপুর সড়কের নরসিংহপুর, নিশ্চিতপুর, ঘোষবাগ ও জিরাবো এলাকায় ৫৩টি পোশাক কারখানায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ ও কর্মবিরতি পালন করেন। এদের মধ্যে ৪৪টি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ছিল। এছাড়া ৯টি পোশাক কারখানায় সকালে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিলেও বিক্ষোভের কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। পরে শ্রম মন্ত্রণালয় জানায়, পোশাক শিল্পের সাম্প্রতিক অস্থিরতা নিরসনের লক্ষ্যে চার জন উপদেষ্টার সমন্বয়ে সভা করে, মন্ত্রণালয়ের একাধিক দল মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন করে, শ্রমিক নেতা ও পোশাক শিল্পের মালিকপক্ষের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করার পরে ১৮ দফা দাবি পূরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যৌথ ঘোষণায় জানানো হয়, দেশের পোশাক শিল্পের সব কারখানার শ্রমিকদের মাসিক হাজিরা বোনাস ২২৫ টাকা বাড়ছে। টিফিন ও রাত্রিকালীন ভাতাও (নাইট বিল) বাড়বে। সেই সঙ্গে আগামী অক্টোবরের মধ্যে বিদ্যমান নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া ১০ অক্টোবরের মধ্যে কারখানা কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকদের সব বকেয়া মজুরি পরিশোধ করা হবে। এগুলোসহ শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে সম্মত হয় মালিকপক্ষ।
কিন্তু এসব দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা আসার চার দিনের মধ্যেই ২৯ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের ভবানীপুর এলাকার আর অ্যান্ড জি বিডি গার্মেন্টস লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা হাজিরা বোনাস, নাইট বিল ও টিফিন বিল বৃদ্ধি, প্রশাসন বিভাগের ব্যবস্থাপকের অপসারণসহ ১২ দফা দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। তাদের দফার সঙ্গে আগের ১৮ দফার মিল থাকার পরও আগের ঘোষণাকে আমলে নিচ্ছেন না তারা। রবিবার দুপুর পৌনে ২টা থেকে বিকাল পৌনে ৫টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা শ্রমিকরা মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। পরে গার্মেন্টের প্রশাসন বিভাগের ব্যবস্থাপক হাসান স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে শ্রমিকরা সড়ক থেকে সরে যায়।
কেন দাবি মেনে নেওয়ার পরেও শ্রমিকরা আন্দোলনে– এই প্রশ্নের জবাবে আশুলিয়া এলাকার আন্দোলনরত শ্রমিক কাশেম আলী বলেন, আমি তো ১৮ দফা জানি না। হঠাৎ একটা একটা করে কারখানা থেকে খবর আসে বন্ধ হয়ে যাওয়ার। বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের দুই-তিন মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়নি। আমারও এমন হয় কিনা সেই ভয়ে রাস্তায় নেমেছি। সবার দাবি মানছে শুনছি, আমাদেরটা পড়ে থাকবে কেন?
এদিকে সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সাভারের আশুলিয়ায় পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে কাউসার হোসেন খান (২৭) নামে একজন নিহত হয়েছেন। এতে আহত হয়েছেন আরও ২০ জন। ১৮ দফা মেনে নেওয়ার পরেও নতুন দফা কেন আসছে এবং শ্রমিকরা কেন পথে, জানতে চাইলে গামেন্টস সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, এই যে ১৮দফা মেনে নেওয়া হয়েছে সেটা সবাই এখনও জানে না। শ্রমিকদের কাছে প্রকৃত তথ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ আমরা করছি। এটা যে সবার জন্য প্রযোজ্য সেটা তো তাদের জানতে হবে।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, নতুন করে ১২ দফা বিষয়ে গণমাধ্যমে দেখেছি। মূল বিষয় ১৮ দফা, যেটা মালিক-শ্রমিক-সরকারের সমন্বিত বোঝাপড়ায় মেনে নেওয়া হয়েছে এবং আমরা সেটাকে সম্মান জানাতে চাই। কিন্তু এটা এত বড় সেক্টর, সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়গুলো জানানো সম্ভব হয়নি এখনও। আমরা ঠিক করেছি শ্রমিকদের মধ্যে এই বিষয়টি আরও সুচিন্তিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করতে হবে। আজও আমরা বিভিন্ন প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে সেটার একটা কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেছি। এটা যত দ্রুত ছড়ানো যাবে, তত ভালো হবে।
কালের আলো/এমএএইচ/ইউএইচ