মাছের রাজা দরিদ্র প্রজার ঘরে আসুন

প্রকাশিতঃ 11:14 am | September 26, 2024

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম:

যখন ইলিশ ধরার নিয়ম-কানুনের বালাই ছিল না তখন ভাদ্র-আশ্বিন মাসে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়তো। নদী-সাগর সব জায়গায় বড় বড় ইলিশের আনাগোনা থাকতো এবং ট্রাক ছাড়াও রেলগাড়িতে দেশের আনাচে-কানাচে সব জায়গার বাজারে চালান হয়ে যেত। স্থানীয় লোকজন বলতো আজ বাজারে চালানি মাছের ছড়াছড়ি। দামও অনেক সস্তা থাকতো।

গ্রামের মানুষ সস্তা ইলিশ কিনে বছরের এই দিনগুলোতে মজা করে খেতে পারতো এবং স্বজনদের বাড়িতে পাঠাতো। এখন ভাদ্র যায়, আশ্বিন যায়, গ্রামের বাজারে ইলিশ আসে না। হাট-বাজারে কিনতে পওয়া যায় ইলিশের মতো দেখতে ওমান-সুদানের সমুদ্রে ধরা বিদেশি শক্ত চন্দনা মাছ। অনেকে ইলশেগুঁড়ি ভেবে চন্দনা মাছ একবার কিনে আনার পর ঠকে গেলে আর কখনও কিনতে চান না, অন্যকে কিনতেও নিষেধ করেন!

এবছর ভাদ্র মাসে ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা শেষে নদী-সমুদ্র থেকে প্রচুর ইলিশ আহরণ করার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে ইন্টারনেটে ইউটিউব, ফেসবুকের সুবাদে আজকাল দুনিয়ার কোথায় কি হয়, কি ঘটে তা গোপন রাখার কোনো ফুরসত নেই। সেদিন সকালে কক্সবাজারে নিকট সমুদ্রে একটি ৩০ কেজির পোপা মাছ ধরা পড়ে। তার দাম হাঁকা হয়েছে সাত লাখ টাকা। কারণ, পোপা মাছের ফুসফুসের আবরণ দিয়ে এক ধরনের সার্জিক্যাল সুতা তৈরি হয়, যার দাম অনেক বেশি। সমুদ্রগামী জেলেরা আজকাল এই তথ্য জানেন। তাই এই মাছ পেলে তারা সঙ্গে সঙ্গে ছবি তুলে নেটদুনিয়ায় ছড়িয়ে দেন। ছবি দেখে বিক্রিও হয়ে যায়। জেলেরা সামান্য দাম পেলেও সেই বিভিন্ন মাছ হাতবদল হয়ে বড় মাছ ব্যবসায়ীর কাছে চলে গিয়ে অকল্পনীয় দামে বিক্রি হয়- জেলেরা সেটা জানতেও পারেন না। এটাই ইন্টারনেটের কারসাজি। ইলিশ নিয়ে কারসাজিটা আরও বিচিত্র।

ইলিশ শিকার শেষে চাঁদপুর, কক্সবাজার কিংবা পাথরঘাটায় ট্রলার ভিড়লে তাজা মাছের ছবি তোলার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে বহু ইউটিউবার। তারা নানা ভঙ্গিতে বাজারের সব মাছের ছবি, ভিডিও তৈরি করে নিজেদের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রচারের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। তাদের ক্যামেরার কৌশল ও ধারা বর্ণনায় চেহারা, ওজন, রং, আকার, দরদামসহ ইলিশের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করার প্রবণতা চলে।

সঙ্গে জেলে, পাইকার, খুচরা বিক্রেতা তাদেরও সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়ে তাকে। এতে সেই ভিডিও দেখে নেটদুনিয়ার সব মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দেরি হয় না। ইউটিউবারদের সুমধুর বক্তব্যের জেরে রান্নাঘরের গিন্নি অথবা গৃহকর্মীও ইলিশ কিনে আনার জন্য আব্দার করতে থাকেন। অতঃপর অনেককেই থলে হাতে বাজারে ইলিশ কিনতে গেলে কি দশা হতে পারে তা কি কেউ অনুমান করতে পারছেন?

এমনিতেই ভরা মৌসুমে ইলিশের চড়া দাম। এবছর রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় ইলিশ রসিকদের মনে আনন্দ বয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হাটে-ঘাটে তার কোনো ইতিবাচক প্রভাব নেই দামে। এত বেশি দাম দিয়ে তাদের কেনার মতো সক্ষমতা নেই। বাজারে গিয়ে তাদের চক্ষু চড়কগাছ!

কেউ মাছের বাজারে খালিব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করে বলছেন, ‘ইলিশের অগ্নিমূল্যের কারণে গত দুই বছরেও একটা মাছ কেনার সাহস হয়নি তার। এক কেজি বারশ গ্রামের একেকটি ইলিশের দাম ১৮০০ থেকে ২২০০ টাকা চাওয়া হচ্ছে। মোটেই কমেনি দাম। শুধু ভাওতাবাজি করা হচ্ছে ইউটিউবে দেখানো ইলিশের দামে!’

বাজারেই শোনা গেলো- ‘নদীতে মাছ আছে, ধরাও পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে। সরবরাহ বেড়েছে সত্যি। কিন্তু ইলিশ মজুত সিন্ডিকেট এবারো চরম সক্রিয় হয়ে উঠেছে।’ প্রতিদিন ভোর হলে সাগর-নদী থেকে শত শত ইলিশভর্তি ট্রলার ঘাটে আসে। ইলিশের পাইকাররা তাদের কাছে আগেই টাকা ধারদেনা করে ট্রলার ভাসিয়েছেন। নদী-সমুদ্রে গিয়ে যে মাছ ধরা হবে তার সিংহভাগই দাদন ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাবে। এই দাদনের টাকার উৎস ভিন্ন জায়গায়। তারা হলেন সুপার মার্কেটের মালিক-স্টেকহোল্ডাররা। তারা অতি মুনাফার আশায় অগ্রিম বিনিয়োগ করেন ইলিশ ধরার জন্য।

জাতীয় মাছ ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করার কার না ইচ্ছে হয়? তাই সরকারিভাবে মৌসুমি ইলিশ সংগ্রহ করে বিশেষ শ্রেণির মানুষের জন্য ভিজিএফ কার্ড দেখে একদিনের জন্য হলেও সুলভ মূল্যে ইলিশ বিক্রির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। জাতীয় মাছ বঞ্চিত মানুষের কাছে মাত্র একদিনের জন্য হলেও এটা হতে পারে একটি যুগান্তকারী উদাহরণ।

সুতরাং ইলিশ যাবে কোথায় বা যাচ্ছে কোথায় বলে যারা আহাজারি করছেন তারা বুঝতেই পারেন না- ইলিশ কার ইশারায় বরফের নিচে চাপা পড়ে যায় হিমঘরের গহীন অন্তরালে!

এক হিসাব অনুযায়ী সাধারণ মানুষের পাতে ইলিশ যাওয়ার কথা, ঘরে ঘরে ঘ্রাণ তোলার কথা এই বৈষম্যবিহীন সমাজের অঙ্গীকার শোনার সময়। কিন্তু তা এখনও হচ্ছে কই? প্রতিদিন খবরে শোনা যায় ইলিশ ধরা পড়ছে প্রচুর পরিমাণে। সেগুলো ইলিশ মজুত সিন্ডিকেট চক্রের তৎপরতায় গোপনে গুদামজাত করা হচ্ছে। তারপর অল্প অল্প করে শুধু বড় বড় শহরের অভিজাত মার্কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। সেসব মার্কেটে সারাবছর ইলিশ কিনতে পাওয়া যায়। এর কোনো ব্যত্যয় এখনও চোখে পড়েনি।

এজন্য দায়ী কে? এর নেপথ্যে বা কারা? মৌসুমি ইলিশের স্বাদ-ঘ্রাণ কি দেশের সাধারণ ও নিম্ন আয়ের মানুষের একদিনের জন্যও পাওয়ার অধিকার নেই? রাতের আঁধারে অবৈধ গুদামজাত করা হচ্ছে কাদের ছত্রছায়ায়? এসব দেখভালের জন্য দ্রুত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠা জরুরি।

শুধু কি শহরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুপার মার্কেটে বড় ইলিশ বিক্রি হবে? সেগুলোর গ্রাহক কোন ধরনের ভোক্তা? সাধারণ চাকরিজীবী পরিবার মার্কেটে গিয়ে ঘুরেফিরে চেয়ে দেখে সরপুঁটি কিনে বাসায় ফিরে আসেন। আর কল্পনায় বা রাতে স্বপ্নে সেই ইলিশ দেখেন। এটাও বর্তমান ইলিশের অগ্নিমূল্যের বাজারে চরম বাস্তবতা!

কারওয়ান বাজারের খোলা কাঁচাবাজারে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ১৮০০-২২০০ টাকা কেজি ! সেখানেও ইউটিউবারের আনাগোনা প্রচুর। কারণ, ছবি দেখিয়ে তাদের আয় হয়, জীবিকা চলে। তারা মনজুড়ানো ছবি দেখিয়ে দাম কমার কথা প্রচার করায় বাজারে মানুষ ভিড় করছে সস্তায় ইলিশ কেনার জন্য। কিন্তু মানুষের ভিড় দেখে মাছের দোকানিরা হঠাৎ করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সেখানেও বাজারদরের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই অবস্থা দেখে অনেক ক্রেতাই হতবাক!

কথা হলো- গত একমাস ধরে পণ্যবাহী বা ইলিশের ট্রাকে কোনো চাঁদাবাজি নেই, টেন্ডারবাজি নেই। মাছের আড়তে হাঁকডাকের সময় চোখ রাঙানি দেখাচ্ছে না স্থানীয় কোনো মাস্তান। তারপরও মাছ উধাও হয়ে চলে যাচ্ছে মজুতদারিদের গুদামে। এখানে নিরুপায় ছোট ব্যবসায়ী ও সাধারণ ভোক্তারা। তাই মৌসুমি ইলিশের অবৈধ মজুতদারির বিরুদ্ধে অচিরেই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। বছরের এই সময়টায় প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামগঞ্জের হাট-বাজারে সরকারিভাবে সস্তায় মৌসুমি ইলিশ বিক্রির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

জাতীয় মাছ ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করার কার না ইচ্ছে হয়? তাই সরকারিভাবে মৌসুমি ইলিশ সংগ্রহ করে বিশেষ শ্রেণির মানুষের জন্য ভিজিএফ কার্ড দেখে একদিনের জন্য হলেও সুলভ মূল্যে ইলিশ বিক্রির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। জাতীয় মাছ বঞ্চিত মানুষের কাছে মাত্র একদিনের জন্য হলেও এটা হতে পারে একটি যুগান্তকারী উদাহরণ।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।