ডিজিএফআই দিয়ে শেখ হাসিনা আমাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেন: এসকে সিনহা
প্রকাশিতঃ 6:03 pm | August 24, 2024
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা তার দেশত্যাগের কারণ হিসেবে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিএফআই দিয়ে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছেন বলে ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে এই দাবি করেন তিনি। এজন্য নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে দেশে ফিরতে প্রস্তুত আছেন বলে জানিয়েছেন।
সাত বছর আগে জোর করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল জানিয়ে ওই সময়ের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, বর্তমান সরকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে তিনি তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা যে মিথ্যা ও বানোয়াট তা প্রমাণ করার জন্য দেশে ফিরতে প্রস্তুত।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দেওয়ার পর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে পদ ও দেশ ছাড়তে বাধ্য হন বিচারপতি এস কে সিনহা।
২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি তার অবসরে যাওয়ার কথা থাকলেও নজিরবিহীন পরিস্থিতির মধ্যে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার ৮১ দিন আগেই তার কার্যকাল শেষ হয়।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের তোপের মুখে ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর বিদেশ থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন তিনি।
দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসা বিচারপতি সিনহা যুক্তরাষ্ট্রে বসেই ২০১৮ সালে একটি বই প্রকাশ করেন। তাতে তিনি দাবি করেন, তাকে ‘পদত্যাগে বাধ্য করে নির্বাসনে’ পাঠানো হয়েছে।
ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছিলেন এস কে সিনহা। নিউজার্সিতে ছোট ভাই অনন্ত কুমার সিনহার নামে কেনা একটি বাড়িতেই সে সময় তিনি থাকছিলেন। পরে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে খবর আসে সিনহা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডায় গিয়ে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন।
বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থপাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ পাওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। বাকি বিষয়গুলো নিয়ে পরে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারকে একটি এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। গত ১৪ আগস্ট বিদেশ থেকে ভিডিও কলের মাধ্যমে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সিনহা বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে ফিরব। এখন আমি গ্রিন সিগনালের জন্য অপেক্ষা করছি।’
ডিজিএফআই সদস্যদের মাধ্যমে শেখ হাসিনা তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিলেন জানিয়ে সিনহা বলেন, তার (শেখ হাসিনা) নির্দেশ ও হস্তক্ষেপ উপেক্ষা করে তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন বলেই তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
সাবেক প্রধান বিচারপতি দাবি করেন, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হওয়ার পর নিম্ন আদালত যাতে বড় বড় চোরাকারবারি ও দুর্নীতিবাজদের জামিন দিতে না পারে সেজন্য কিছু উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকেই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়।
বিচারপতি সিনহা নির্বাহী বিভাগের পরিবর্তে নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণে বিচারকদের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে রেখে শৃঙ্খলা বিধিমালা প্রণয়নের জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন এবং ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ষোড়শ সংশোধনীর (সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণ) মামলার রায় সরকারের অনুকূলে দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর এই দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছায়।
শেষের দিকের দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে সিনহা জানান, ‘ বাংলাদেশে আমার শেষ দিনগুলো ছিল খুবই ভয়ংকর, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এটা কেবল উপলব্ধি করা যায়। আমি প্রধান বিচারপতি ছিলাম, সেই আমাকেই গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। আমাকে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। আমার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। আমার বাড়ির চারপাশে নিরাপত্তা বাহিনী (গোয়েন্দারা) পাহারা বসায়। আমার একজন স্টাফ বাসায় ঢুকতে গেলে তাকে পেটানো হয়। ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন প্রধান সাইফুল আবেদীন মধ্যরাতে আমাকে বিরক্ত করতেন এবং পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার জন্য চাপ দিতেন।’
সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে তার সহকর্মীরা (বিচারপতিরা) সরকারের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে আদালতে তার সঙ্গে বসতে অস্বীকৃতি জানান এবং তাকে বলেন যে হাইকোর্টের বিচারপতিরা তাকে সহযোগিতা করবেন না। এতে তিনি প্রচণ্ড মানসিক চাপে পড়েন। তখন আমি ভেবেছিলাম আমার দেশে থাকার কোনো অধিকার নেই।
২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর বিদেশ যাওয়ার আগে ঢাকায় সরকারি বাসভবনের সামনে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন এসকে সিনহা।
বিচারপতি সিনহা বলেন, আগের রাতে (২ জুলাই) তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে থাকা আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের (বর্তমানে মৃত) সঙ্গে বৈঠকের জন্য বঙ্গভবনে ডেকে পাঠান। বৈঠকে শেখ হাসিনা তাকে পরদিন (৩ জুলাই) সরকারের পক্ষে রায় দিতে বললেও তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বার্থে তা প্রত্যাখ্যান করেন।
সিনহা বলেন, ‘আমি ধারণা করতে পারি যে প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চের অন্য বিচারপতিদের সরকারের পক্ষে রায় দিতে রাজি করিয়েছেন। একপর্যায়ে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডা চরমে ওঠে এবং আমি তাকে বলেছিলাম যে আমি এখনই পদত্যাগ করব। তখন তিনি আমাকে পদত্যাগ না করার অনুরোধ করেন এবং বলেছিলেন আমি পদত্যাগ করলে জনগণ এটা খুব খারাপভাবে নেবে। তিনি আমাকে আমার ইচ্ছামতো কাজ করার কথা বলেন।’
বিচারপতি সিনহা বলেন, ২০১৭ সালের ৩ জুলাই আপিল বিভাগের সাত বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সর্বসম্মতিক্রমে রায় দেওয়ার পর শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যরা পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিষোদগার করেছিলেন। তখন আমি ভেবেছিলাম সরকার হয়তো আমাকে আর দেশে থাকতে দেবে না। আমি তড়িঘড়ি করে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কার্যক্রম (রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশসহ) শেষ করেছিলাম। আমি এশিয়া প্যাসিফিক দেশগুলোর প্রধান বিচারপতিদের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে জাপানে গিয়েছিলাম। কনফারেন্স রুম থেকে বের হওয়ার পর ডিজিএফআই থেকে ফোন আসে এবং আমাকে দেশে ফিরতে নিষেধ করা হয়। একদিন পর আমি সিঙ্গাপুর হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসি। ঢাকায় বিমানবন্দরে নামার পর দেখতে পাই পাঁচ-ছয়জন ডিজিএফআই সদস্য আমাকে ঘিরে রেখেছে। তারা সেখানে উপস্থিত আমার কর্মকর্তাদের কাছে যেতে দিচ্ছিলেন না। একজন লম্বামতো লোক আমাকে বললেন, তারা আমার সঙ্গে এক কাপ কফি খেতে চান এবং আমাকে তাদেরকে পাঁচ মিনিট সময় দিতে বলেন। আমি তাদের ভাষা সংযত করতে বলি এবং প্রোটকল মানতে বলি। রেগে গিয়ে বলি, ‘গেট লস্ট’। আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অজুহাতে তারা আমার সঙ্গে গাড়িতে উঠতে চেয়েছিল। আমি তাদের বলি যে আমার একটি গাড়ি এবং নিরাপত্তা আছে। আমার তাদের কোনো দরকার নেই এবং চলে যাই। এটা ছিল আরেকটি বাজে সংকেত।’
‘আমি আদালতে সুপ্রিম কোর্টে যাই। একদিন আমি সবেমাত্র আমার কাজ শেষ করেছি তখনই ডিজিএফআই প্রধান আমার অফিসে আসেন। তিনি আমাকে বলেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনি আমাকে পদত্যাগ করতে এবং দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। আমি চিৎকার করে বললাম ‘আপনি কে এবং আপনি এসব কী বলছেন? ডিজিএফআই প্রধান বলেন, তারা শুধু প্রধানমন্ত্রীর আদেশ বাস্তবায়ন করেন, আইনমন্ত্রী বা অ্যাটর্নি জেনারেলের নয়। আমি তাকে বেরিয়ে যেতে বলি। এরপর আমি ঘরে ফিরে গেলে আমাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।’-বলেন সিনহা।
সাবেক প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আমাকে বলেছিলেন যে তাদের কিছু করার নেই। তিনি আমাকে কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিতে বলেছিলেন। আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার সেক্রেটারি সাত দিনের ছুটির জন্য একটি দরখাস্ত তৈরি করেছিলেন এবং আমি তাতে সই করেছিলাম। বিকেলে আমি বাসায় ফিরে দেখি আমার বাসভবনের সমস্ত দরজা বন্ধ।
সাদাপোশাকে সেনা সদস্যরা আমার বাসভবনের ভেতরের সব জিনিসপত্র দখলে নিয়েছিল। আমার বাসার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। পরদিন সকাল ১০টার দিকে আমি আমার আবাসিক অফিসে আমার কাজ করছিলাম। মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা আমাকে ফোন করে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। আমি তাকে আমার বাসায় আসতে বলেছিলাম। তিনি (ওয়াহহাব) আমাকে তার বাসায় যেতে বললেন।
তিনি বলেন, তার বাসায় অন্য বিচারপতিরা আছেন। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম, এখানে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমি তাদের আমার বাসায় আসার জন্য ডাকলাম। তখন তারা এসে আমাকে জানায় যে, তারা আমার সঙ্গে আদালতে বসবে না। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। সরকারের প্রভাবিত হয়ে তারা (বিচারপতিরা) এই অবৈধ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ অবস্থার মধ্যেই ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর রাতে ঢাকা ত্যাগ করেন বিচারপতি সিনহা।
বিচারপতি সিনহার অনুপস্থিতিতে তৎকালীন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি ওয়াহাব প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
সাক্ষাৎকারে বিচারপতি সিনহা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে অভিনন্দন জানান। সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন, তিনি বাংলাদেশে ফিরতে প্রস্তুত।
এস কে সিনহা বলেন, ‘আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে আমি দেশে ফিরব। আমি সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছি। আমি সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করব এবং প্রমাণ করব যে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো মিথ্যা।’
কালের আলো/এমএএইচ/ইউএইচ