সুনীল অর্থনীতির বিকাশে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার; আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ‘নন্দিত’ নৌবাহিনীর হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভিসের সেবা

প্রকাশিতঃ 9:26 pm | June 25, 2024

কালের আলো রিপোর্ট:

বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিরসনের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করেছে বিশাল বিস্তীর্ণ সমুদ্র এলাকা। খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। বিস্তীর্ণ সমুদ্র অঞ্চলের সম্পদের সুরক্ষা এবং সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্রমধারা আরও গতিশীল রাখতেও হাইড্রোগ্রাফিক কর্মকাণ্ডের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। একই সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে সমুদ্র সচেতনতা বাড়াতে ও সুনীল অর্থনীতির বিকাশকে বেগবান করতে সমুদ্রভিত্তিক কার্যক্রমসমূহের টেকসই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে ‘বিশ্ব হাইড্রোগ্রাফি দিবস’।

আন্তর্জাতিক হাইড্রোগ্রাফিক সংস্থা (আইএইচও) প্রতিষ্ঠার দিনকে স্মরণীয় করে রাখার প্রয়াসে এবং বিশ্বব্যাপী হাইড্রোগ্রাফি পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের অসামান্য অবদানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার লক্ষ্যে ‘সামুদ্রিক কার্যক্রমে নিরাপত্তা, দক্ষতা ও টেকসই উন্নয়নে হাইড্রোগ্রাফিক তথ্যের গুরুত্ব’ এই স্লোগান নিয়ে এবারও বাংলাদেশে পালিত হয়েছে ‘বিশ্ব হাইড্রোগ্রাফি দিবস’। মঙ্গলবার (২৫ জুন) বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় ঢাকায় বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর মাল্টিপারপাস হলে দিবসটিকে ঘিরে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমুদ্রে দেশি-বিদেশি জাহাজসমূহের নিরাপদ চলাচল, সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই আহরণ ও কার্যকরী ব্যবহারে হাইড্রোগ্রাফিক তথ্য-উপাত্ত মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে বলে মত দেওয়া হয়।

সেমিনারে প্রধান অতিথি নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি ও বিশেষ অতিথি নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান হাইড্রোগ্রাফি সংক্রান্ত উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং তথ্য-উপাত্তের প্রায়োগিক ব্যবহারের মাধ্যমে সমুদ্র সম্পদের নিরাপদ, টেকসই ও কার্যকরী ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সমুদ্র বিজ্ঞানী, সমুদ্র ব্যবহারকারী সংস্থা ও দেশসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে বলেও মনে করেন তাঁরা।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইড্রোগ্রাফিক কমিটির সদস্য, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও মেরিটাইম সংস্থার সদস্য ও গবেষকদের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণে সেমিনারটিতে সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তি বৃদ্ধিতে হাইড্রোগ্রাফিক এবং আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্যের প্রয়োগ, সামুদ্রিক কর্মকাণ্ডের সুরক্ষা ও স্থায়ীত্ব বৃদ্ধিতে আধুনিক হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ কৌশল অবলম্বন এবং স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য হাইড্রোগ্রাফিক তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় সুনীল অর্থনীতির দুয়ার উন্মোচন ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত এবং ন্যাশনাল হাইড্রোগ্রাফি কমিটির চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম আনোয়ার হোসেন বক্তব্য রাখেন।

আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, হাইড্রোগ্রাফি সংক্রান্ত কার্যক্রমে বাংলাদেশের একটি দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশ ২০০১ সালের ২ জুলাই আন্তর্জাতিক হাইড্রোগ্রাফিক সংস্থার ৭০তম দেশ হিসেবে সদস্যপদ লাভ করে। সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০৫ সাল থেকে এ দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে আসছে।

সুনীল অর্থনীতির বিকাশে বহুমুখী উদ্যোগের সুফল ভোগ করবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বর্তমান সরকার সুনীল অর্থনীতির বিকাশের লক্ষ্যে যেসব বহুমুখী উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তার অবারিত সুফল ভোগ করবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, এমন মন্তব্য করেছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে এদেশকে স্মার্ট ও উন্নত করে তুলতে হাইড্রোগ্রাফি, সমুদ্র বিজ্ঞান এবং সুনীল অর্থনীতিকে আরও এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বদ্ধপরিকর।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমুদ্র অর্থনীতিবিষয়ক দূরদর্শিতার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ-কিলোমিটারজুড়ে বাংলাদেশের একচ্ছত্র সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হয়েছে। সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি— সুবিশাল অর্থনৈতিক এলাকা।

তিনি বলেন, দেশের সমুদ্র এলাকায় হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ পরিচালনা ও এসংক্রান্ত সেবাদানের মাধ্যমে নিরাপদ নেভিগেশন ও সামুদ্রিক অর্থনীতির বিকাশে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ভবিষ্যতে আরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। সুনীল অর্থনীতির বিকাশের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের শাসনামলে পায়রা সমুদ্র বন্দর, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর, বঙ্গবন্ধু টানেনের মতো মেগা প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে এবং মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল পাওয়ার প্ল্যান্ট, নতুন এলএনজি টার্মিনাল, অফশোর রিনিউয়েবল এনার্জি প্রকল্প, সমুদ্র তলদেশের তেল ও গ্যাস সাপ্লাই পাইপলাইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

এসব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং কারিগরি বিষয়ে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভিসকে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। বিশ্বের উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে আধুনিক হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ জাহাজ এবং স্মার্ট সরঞ্জাম সংযোজন করে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আজকের এই দিনব্যাপী সেমিনার আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেশের মেরিটাইম সেক্টরের অংশীজন এবং নীতি নির্ধারকদের মধ্যে সমন্বয় আরও সুদৃঢ় হবে। সামুদ্রিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং সমুদ্রকে নিরাপদ ও কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে দেশের সমুদ্র ব্যবহারকারী সব সংস্থার মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

নৌবাহিনীর হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভিসের সেবা আজ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্বীকৃতি লাভ করেছে সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে নিরাপদ জাহাজ চলাচল নিশ্চিতকরণ ও সুনীল অর্থনীতি প্রসারের পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়নে হাইড্রোগ্রাফিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

আন্তর্জাতিক হাইড্রোগ্রাফিক সংস্থায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা হিসেবে এই কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিতে পেরে বাংলাদেশ নৌবাহিনী অত্যন্ত গর্বিত ও আনন্দিত। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সমুদ্র সম্পদের গুরুত্ব অনুধাবন করে স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন (আনক্লস) বাস্তবায়িত হবার ৮ বছর পূর্বেই টেরিটরিয়াল ওয়াটার্স এন্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট-১৯৭৪ প্রণয়ন করেন।’

তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাংলাদেশের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সমুদ্র বিজয় দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত উন্নয়নের ধারক। এই বিশেষ অর্জনে বাংলাদেশ নৌবাহিনী কর্তৃক জরিপকৃত তথ্য-উপাত্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে যা প্রশংসার দাবিদার।’

বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা এবং অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশে সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও টেকসই উন্নয়নের গুরুত্ব অপরিসীম জানিয়ে এডমিরাল এম নাজমুল হাসান আরও বলেন, ‘দেশের সমুদ্র এলাকায় যে কোন ধরনের আগ্রাসন প্রতিরোধ, মেরিটাইম স্বার্থ রক্ষা ও সমুদ্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এবং কূটনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ নৌবাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। শান্তিকালীন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর উপর অর্পিত দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম হলো সমুদ্রে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ পরিচালনা করা। বিগত ১৯৮৩ সালে সীমিত পরিসরে হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভিসের যে যাত্রা শুরু হয়েছিলো, আজ তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বহুল পরিচিত এবং সমাদৃত।’

তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টির প্রতিফলন হিসেবে নৌবাহিনীকে শক্তিশালী, যুগোপযোগী ও আধুনিক করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে নৌবাহিনীর হাইড্রোগ্রাফিক সক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশেষায়িত জরিপ জাহাজ এবং প্রযুক্তি সমৃদ্ধ আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন অব্যাহত রয়েছে। দক্ষ জনবল ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানদন্ড বজায় রেখে বাংলাদেশ নৌবাহিনী কর্তৃক প্রকাশিত নটিক্যাল চার্ট ও ইলেকট্রনিক নেভিগেশনাল চার্ট বিশ্বব্যাপী সরবরাহ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভিসের সেবা আজ শুধুমাত্র নৌবাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্বীকৃতি লাভ করেছে।’

‘দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ভৌগলিক বৈচিত্র্য ও পরিবেশগত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সমুদ্রপথে নিরাপদ নৌ চলাচল বজায় রাখতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাইড্রোগ্রাফিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত সকলকে তাদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালনের জন্য জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমুদ্র সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার ও টেকসই উন্নয়নের পাশাপাশি সমুদ্র সম্পদের সুরক্ষা ও নিরাপদ নৌ চলাচল নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশে হাইড্রোগ্রাফিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত সকলে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে আমি বিশ্বাস করি’-যোগ করেন নৌবাহিনী প্রধান।

কালের আলো/এমএএএমকে