বাঙালি সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা : নতুনের আবাহনে চেতনায় অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ
প্রকাশিতঃ 9:19 am | April 14, 2024
এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান :
সময় পরিবর্তনশীল। হাজার বছরের বাংলায় আরেক দফা সময়ের পালাবদল। আরেকটি পহেলা বৈশাখ বাঙালির সংস্কৃতিরই অগ্রযাত্রা। আবহমান বাংলার সংস্কৃতির নিজস্ব দিন রঙিলা পহেলা বৈশাখ। বাঙালিত্বকে জাগিয়ে তোলার পাশাপাশি শাণিত করে। প্রকাশ ঘটায় জাতিসত্তার। নববর্ষের অতীতের রঙ রূপ, বৈশিষ্ট্যকে অনুধানে স্বয়ংক্রিয়। তেমনি সমকালীন সংস্কৃতি তাঁর বৈচিত্র্য ও সৃজনশীলতাকে সঞ্চালিত করে। ভবিষ্যতে এগিয়ে চলার শক্তি ও অনুপ্রেরণার উৎসহ হয়ে উঠে। ফল্গুধারা বয়ে যায় চারিদিকে। সম্ভাবনার পানসিতে চড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া।
লাল-সাদা পোশাকের বাহার থেকে শুরু করে খানাপিনা সব জায়গাতেই প্রাধান্য পায় বাঙালিয়ানা। আড্ডা, ঘোরাঘুরি, আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে শিকড়সন্ধানী উৎসবে নিজেকে মেলে ধরা। গ্রামের হালখাতার হাওয়া এখন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছে নগর জীবনে। উৎসব, উচ্ছ্বাস আর উল্লাসে মেতে উঠে জেলার প্রতিটি গ্রামের মাঠঘাট-প্রান্তর।
নাগরদোলা আর ইলিশ-পান্তার স্বাদ নগরজীবনে অনেককে টেনে নিয়ে যাবে স্মৃতিতাড়িত শৈশবে। স্বাগত জানানো হবে নতুন সম্ভাবনা জাগানিয়া উদীয়মান সূর্যকে। নববর্ষের প্রথম দিনে বদলে যাবে রাজধানী ঢাকার দৃশ্যপট। শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলায় বর্ণবহুল হয়ে উঠবে নগরী। বরাবরের মতোই ভোর সোয়া ছ’টায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের প্রভাতী অনুষ্ঠানে ভোরের সুর তুলে শুরু হবে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা। এর সঙ্গে সঙ্গেই রমনার বটমূল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ধানমণ্ডির লেকের পাড়, সংসদ ভবনসহ শেরেবাংলা নগর, গুলশান, বনানী, উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ পুরো রাজধানীই বৈশাখী আমেজে মেতে উঠবে। কাকডাকা ভোর থেকেই নগরীর পথে ঢল নামবে বাঙালি সংস্কৃতি লালনকারী আনন্দপিয়াসী নগরবাসীর। সবার পরনেই থাকবে বৈশাখী রং লাল, সাদার পাশাপাশি অন্যান্য রঙের বাহারি নকশার পোশাক।
সেকালের নববর্ষের হালচাল নিয়ে সংখ্যাতীত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। সাহিত্য, কবিতা, গান, নাচ বাংলা নববর্ষে উজ্জীবিত এবং প্রাণিত। বসন্তের পর গ্রীষ্মকালীন সূচনায় বৈশাখ প্রকৃতির রূপান্তর। তেমনি বৈশাখের আবেদন সার্বজনীন। সব বয়সের, নারী-পুরুষের মন এই বৈশাখে পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে বরণ করে। একেকজনের চিন্তা-চেতনা, মেধা-মননে নতুনের আবাহনে নয়া উদ্যমে স্বপ্নগুলোর বাস্তবায়নে নিজেকে নিয়োজিত করে। অবশ্য এর চেতনায় রয়েছে অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ। যা প্রগতির পক্ষে প্রতিক্রিয়ার বিপক্ষে। জীর্ণতাকে পিছে ফেলে, সাফল্য-ব্যর্থতার সালতামামিতে বৈশাখ মানুষকে নতুনভাবে জাগ্রত করে। পরম্পরার ঐতিহ্যকে লালন করে বাঙালিয়ানাকে সবার ওপরে তুলে ধরার নামই বৈশাখী উৎসব। শুদ্ধ বাঙালি হওয়ার প্রেরণা সঞ্চারিত হয় দিনটিতে।
হাজার বছরের জাতি-সংস্কৃতি বিশ্বমানের। মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন বিশ্ব ঐতিহ্য। বলা চলে, বিশ্বের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল। ইউনেস্কো স্বীকৃত এই নান্দনিক ঐতিহ্য শুধু জীবনাচারের কথা বলে না, সম্মিলিত মানুষের জীবনবোধের প্রতীকও বটে। যেখানে বাঙালির ঐতিহ্যের শিল্পকর্ম কুড়েঘর, ঢেঁকিতে ধান ভাঙা, পাখ-পাখালি ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি ঠাঁই পায়। ঐতিহ্যের এই শোভাযাত্রায় কথা বলে শ্রেণি-পেশার লোক সংস্কৃতি এবং কৃষ্টির উপাখ্যান। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ও কোন কোন সময় উঠে আসে বর্ণিল শোভাযাত্রায়।
আমরা সবাই বাঙালি। এটিই হচ্ছে বৈশাখের প্রধান বার্তা। জাতির গর্ব ও গৌরব, সমাজ সংসারের চালচিত্র, খেলাধূলা, যাপিত জীবন নিয়ে নববর্ষ-যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মধ্যে আমাদের সভ্যতার মহিমাকে গৌরবোজ্জ্বল করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নববর্ষ তাঁর সাংস্কৃতিক আবহের সাথে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের সমীকরণকেও প্রস্ফুটিত করে। জাতীয়তাবোধ, জাতির স্বাতন্ত্র্য, স্বাধিকার, জাতির মুক্তির আকাঙ্খা, স্বাধীনতা সংগ্রাম চেতনায় রয়েছে নববর্ষের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ছাপ। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলা নববর্ষ প্রাণবন্ত। ছায়ানটের সেই ছায়াতল থেকে নতুন সকাল, নতুন স্বপ্ন এবং সুন্দর আগামীর আগমনী সুর হয়ে আসে, রঙের আবির ছড়ায় শুভ নববর্ষ।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক সন্ধানী বার্তা
এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, কালের আলো.কম