বহুমুখী চ্যালেঞ্জের ইতিহাসের বৃহত্তম বাজেট

প্রকাশিতঃ 9:33 pm | June 01, 2023

কালের আলো রিপোর্ট :

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ডলার সংকটে সৃষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় নানা শঙ্কা মাথায় রেখেই বহুমুখী চ্যালেঞ্জের বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ‘উন্নয়ন অগ্রযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’ শিরোনামে এবারের বাজেটে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, ভর্তুকির চাপ সামমলানো এবং রাজস্ব আয় বাড়ানোসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা কৃষি, খাদ্য, নতুন কর্মসংস্থান সৃজন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।

প্রস্তাবিত এই বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ধরা হচ্ছে ৬ দশমিক ০ শতাংশ। যেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

বৃহস্পতিবার (১ জুন) ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করেন। ইতিহাসের বৃহত্তম এই বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বাজেট অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।

জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে মূল্যস্ফীতি, সরকারি ব্যয়, লেনদেনের ভারসাম্য, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর। যুদ্ধ ও যুদ্ধকেন্দ্রিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তখন বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য, সার ও জ্বালানি তেলের মূল্য অনেকখানি বেড়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, নজিরবিহীন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে উন্নত দেশগুলো, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধাপে ধাপে নীতি সুদের হার বাড়িয়েছে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের এসব পরিবর্তন আমাদের অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করছে। যুদ্ধ-পূর্ববর্তী দশকে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ যুদ্ধ শুরুর পর বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি ও দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের অবচিতির কারণে আমদানি ব্যয়বৃদ্ধির ফলে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি বেড়ে আগস্ট ২০২২ সময়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ হয়। ফলে চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব হবে না।

নতুন এই বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে চলতি অর্থবছরের মতোই ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হচ্ছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ২ লাখ ৬১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা।

অর্থমন্ত্রী আশা প্রকাশ করে বলেছেন, আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। দারিদ্রসীমার নিচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ। চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়।

অর্থমন্ত্রী বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি সীমিত থাকবে ৪-৫ শতাংশের মধ্যে। বাজেট ঘাটতি থাকবে জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে ২০ শতাংশের বেশি। বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৪০ শতাংশ।

বাংলাদেশে শতভাগ ডিজিটাল অর্থনীতি আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক স্বাক্ষরতা অর্জিত হবে বলে আশা করেন তিনি।

আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাবে। স্বয়ংক্রিয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, টেকসই নগরায়নসহ নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সব সেবা থাকবে হাতের নাগালে। তৈরি হবে পেপারলেস ও ক্যাশলেস সোসাইটি। সবচেয়ে বড় কথা, স্মার্ট বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা।

মন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনের উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রাখবে। স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট ইকোনমির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে স্মার্ট বাংলাদেশ।

বাজেটের আয়-ব্যয়
প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের চূড়ান্ত আকার (ব্যয়) ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয় ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ঘাটতি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ ৫ দশমিক ২ শতাংশ। বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।

বাজেটের আয় আসবে যেভাবে
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মোট আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর কর ছাড়া আয় ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং বহির্ভূত আয় ২০ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক অনুদান থেকে আয় ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

ঘাটতি পূরণ করা হবে যেভাবে
আগামী অর্থবছরের বাজেটে মোট ঘাটতি ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক অনুদান বাদে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৫৭ লাখ ৮৮৫ কোটি টাকা। ঘাটতি বাজেট পূরণের সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। আর বিদেশ থেকে ঋণ নিচ্ছে ১ লাখ ২ হাজার হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণের মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঋণ নেওয়া হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং অনান্য খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৮৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা এবং স্বল্পমেয়াদী ঋণ ৪৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা।

উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য
আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সংশোধিত জিডিপির চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির পরিমাণ ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)
আগামী অর্থবছরের জন্য এডিপি’র আকার ধরা হয়েছে লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জন্য এডিপি’র আকার ছিল দুই লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। আাগামী বাজেটের পরিচলন ব্যয় ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। খাদ্যে ব্যয় ৫০২ কোটি টাকা এবং ঋণ অগ্রিম বাবদ ব্যয় ৮ হাজার ৪২০ কোটি টাকা।

কালের আলো/ডিএস/এমএম

Print Friendly, PDF & Email