ঢাকা ওয়াসার খোলনলচে পাল্টে দেয়ার কারিগর তাকসিম এ খানের নতুন মিশন ‘স্মার্ট ওয়াসা’

প্রকাশিতঃ 8:34 pm | December 27, 2022

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

চ্যালেঞ্জ নিতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কাজের মাধ্যমেই সমালোচনার জবাব দেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা বাস্তবায়নে গড়েছিলেন ডিজিটাল ঢাকা ওয়াসা। নিজ সংস্থার প্রায় ৮০ ভাগ কর্মযজ্ঞ ডিজিটাল পন্থায় বাস্তবায়নে সফলতার পর এবার তাঁর গভীর মনোযোগ প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশের আদলে ‘স্মার্ট ওয়াসা’ গড়ে তোলার। নিজের নতুন এই মিশনেও সফলতার স্বাক্ষর রাখতে চান অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান।

মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় নিজেই দিয়েছেন এই সুসংবাদ। বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজ’র আয়োজনে ‘সুপেয় পানি প্রাপ্তি ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণার সঙ্গে মিল রেখে ঢাকা ওয়াসাকে ‘স্মার্ট ওয়াসা’ করতে কাজ শুরুর কথাই জানিয়েছেন এমডি তাকসিম এ খান। আশাবাদী উচ্চারণ করে ঢাকা ওয়াসার খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার এই কারিগরের অমিত দৃঢ়তায় উচ্চারণ- ‘ঢাকা ওয়াসা এরইমধ্যে ৮০ শতাংশ ডিজিটালাইজেশনের আওতায় এসেছে। আগামীতে সরকারের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের ঘোষণার সঙ্গে মিল রেখে স্মার্ট ওয়াসা বাস্তবায়নে আমরা এরইমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তিগতভাবে বিশ্ব অনেক এগিয়ে গেছে। এটি শিল্পবিপ্লবের একটি ধারাবাহিকতা। আমরাও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছি। প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে যেটা প্রয়োজন সেটা হলো, সমগ্র পানি ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজড বা অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসা। ইতোমধ্যে ওয়াসার ৮০ ভাগ কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশনের আওতায় এসেছে।’

ঢাকা ওয়াসার এমডি সুসংবাদ জানিয়ে আরও বলেন, ‘আইটি বেইজড অটোমেশন, ডিজিটালাইজেশন ও কম্পিউটারাইজড এই তিনটি প্রক্রিয়ার আওতায় ওয়াসাকে পুরোপুরি নিয়ে আসার কাজ চলছে। স্মার্ট পানি ব্যবস্থাপনার কাজ এগিয়ে চলছে। সব কিছু ডিজিটালাইজ হবে। মেনুয়াল কিছু থাকবে না।’

এ আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও পানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. কাজী মতিন আহমেদ।

২০০৯ সালে তাকসিম এ খানকে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে নিয়োগ দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। পরে তার মেয়াদ বাড়ানো হয় ছয় দফা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ওপরেই পূর্ণ আস্থা রাখেন। ফলে তাকে ষষ্ঠবারের মতোন আরও তিন বছরের জন্য তাকে নিয়োগ দেয় সরকার। কাজের মাধ্যমেই নিজেকে বারবার প্রমাণ করেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। তাঁর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বেই ঢাকা ওয়াসা পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় হয়ে উঠেছে ‘রোল মডেল’। ইতোমধ্যেই ওয়াসা রাজধানীবাসীর চাহিদার চেয়ে বেশি পানি উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে।’

অঙ্গীকার করেছিলেন রাজধানীর এককজন মানুষও পানি সেবার বাইরে থাকবে না। প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছেন। রাজধানীর পানি সরবরাহের নেটওয়ার্ক পদ্ধতি সাজিয়েছেন নতুন করে। ডিস্ট্রিক্ট মিটার এরিয়া বা ডিএমএ নামে একটি নেটওয়ার্ক পদ্ধতির আওতায় এনেছেন ওয়াসাকে। ঢাকাকে ১৪৫টি ক্লাস্টারে (ডিস্ট্রিক্ট মিটার এরিয়া বা ডিএমএ) ভাগ করেছেন। ইতোমধ্যে বেশিরভাগের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ডিএমএর কাজ ২০২৩ সালের মধ্যেই শেষ হবে। এই কাজ শেষ হলেই পানির মান নিয়ে আর কোন প্রশ্ন থাকবে না। একেকটি ভাগে পানি ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক করা হয়েছে।

প্রতিটি নেটওয়ার্ক অন্যজনের থেকে আলাদা ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। এতে ২৪ ঘণ্টা এই এলাকাগুলোয় পানি থাকে। এক জায়গা থেকে নোংরা পানি অন্য জায়গায় যাওয়ার সুযোগ নেই। এটা স্মার্ট পানি ব্যবস্থাপনার একটি অংশ। এখন ৯০ ভাগ স্বচ্ছ পানি সরবরাহ করতে পেরেছে ঢাকা ওয়াসা। সামনের দিনগুলোতে এই স্বচ্ছতা ১০০ ভাগে নিয়ে যেতে চান এমডি তাকসিম এ খান।

পানি ব্যবহারে সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব পানীয় জলের সার্বজনীন অ্যাক্সেসসহ শিল্প, শক্তি, কৃষি এবং বাস্তুতন্ত্রের জন্য পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করার নতুন পথ তৈরি করবে। এর সুফল আমরা কতটা নিতে পারবো তা নির্ভর করবে আমাদের প্রয়োজনীয় দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির ওপর। একই সঙ্গে পানি ব্যবহারে সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল। ঢাকা ওয়াসা এককভাবে এই কাজ করতে পারবে না। তবে ওয়াসার প্রস্তুতি আরও বেগবান করতে হবে।

তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান বিভিন্ন পরিকল্পনা আগামীর পানি ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সুযোগ কাজে লাগিয়ে এসব সমাধানের উপযোগী করতে হবে। প্রয়োজনীয় অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত করে পানি সরবরাহ এবং ব্যবস্থাপনা খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলেই আগামীতে সার্বজনীন পানির অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব।’

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, ‘বিশ্বে সরাসরি ব্যবহারযোগ্য সুপেয় পানির প্রায় ৯৮ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানি। যার কারণে আমরা এ কথা সহজেই বলতে পারি যে এটি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ।

ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে আলাদা উপস্থাপনায় ওয়াসার উপদেষ্টা সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আবুল কাশেম বলেন, বিশ্বে বিরাজমান পানি সংকটের মধ্যেই আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করছি। এটা নিয়ে আমরা অনেক কথা বলছি এবং প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু এর ফলে পানি সম্পদ এবং এর ব্যবস্থাপনার ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়ে খুব বেশি কথা হচ্ছে না আমাদের দেশে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের জন্য কী সংকট নিয়ে আসতে পারে অথবা কোন ধরনের নতুন সম্ভাবনার জন্ম দিতে পারে তা নিয়ে বিশদ আলোচনা দরকার। একই সঙ্গে দরকার সংকট সমাধান অথবা নতুন সম্ভাবনার সদ্ব্যবহারের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি। আমাদের শিল্পখাতে আর পানি সবরাহ কাজে নিয়োজিত সংস্থাগুলির চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পাশাপাশি চতুর্থ পানি বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করা এখনই প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শুরু হওয়া কর্ম পরিকল্পনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের দেশের উপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন এবং প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির পদক্ষেপ বেগবান করা দরকার।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকা ওয়াসার নতুন যাত্রা
আলোচনা সভায় ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান বলেন, ‘২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী যখন ক্ষমতায় আসলেন, তখন বললেন সমগ্র পানি ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে। তখন থেকেই ওয়াসা নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। ২০০৯ সালের আগে ঢাকা শহরের ৬০ শতাংশ মানুষ পানি পেত, বাকি ৪০ শতাংশ মানুষ পানি পেত না। ২০১৩ সালে এসে আমরা চাহিদার চাইতে বেশি পানি উত্তোলনে সক্ষম হয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকার পানির স্তর ধীরেধীরে নেমে যাচ্ছে। সেখান থেকে উত্তরণের উপায় হলো সারফেস ওয়াটারকে ট্রিটমেন্ট করা। কিন্তু সেখানে গিয়েও বিপত্তি। ঢাকার চারপাশে কয়েকটি নদী আছে। কিন্তু সেগুলো এতোটাই দূষিত যে সেটাকে ট্রিটমেন্ট করা যায়, যা আমাদের দুর্ভাগ্য। ফলে আমাদের পানি আনতে হচ্ছে পদ্মা বা মেঘনা নদী থেকে।’

ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘আমরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দিকেও এগিয়েছি। যেমন কোনো এলাকার পানি যদি দূষিত হয়ে পড়ে, সে সিস্টেম আমাকে জানিয়ে দেবে যে এখানে ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। আমাদের ওয়াটার পাম্পগুলো স্ক্যাডার অধীনে চলে এসেছে। ৯০০ পাম্প এর মধ্যে সাড়ে পাঁচশ পাম্প স্ক্যাডার অধীনে রয়েছে। আমাদের পরবর্তী ধাপ হলো এন্ট্রারপ্রেনার রিসোর্স প্ল্যানিং। যার মাধ্যমে ওয়াসার সার্বিক কার্যক্রম একদম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ডিজিটালের আওতায় চলে আসবে। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে আশা করছি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমরা সামনে এগিয়ে যাব।’

ঢাকা ওয়াসার এমডি বলেন, ‘আমরা পানি ব্যবস্থাপনায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আছি। ঢাকা ওয়াসার শতকরা ৮০ ভাগ কর্মকাণ্ড আইটি বেইজ। বেশিরভাগ পাম্পগুলোকে আমরা স্কাডারের আওতায় আনতে পেরেছি। স্কাডারের মাধ্যমে আমরা এখন ঘরে বসে পাম্প চালাতে পারছি। এটাই হচ্ছে আমাদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা পানি বিপ্লব।’

খাবার পানির উৎস হিসেবে পদ্মা নদী
ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ঢাকা ওয়াসা) চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা পানি বিপ্লবে ঢুকে গেছে বলে মনে করছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। একই সঙ্গে ঢাকায় খাবার পানির উৎস হিসেবে পদ্মা নদী যুক্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। পদ্মা নদী থেকে ঢাকায় পানি আনার ব্যাপারে তাকসিম এ খান বলেন, ‘বেশি বেশি করে আমরা সারফেস ওয়াটারে যাচ্ছি, কারণ ঢাকার পানির লেভেল নেমে যাচ্ছে, যেটা পরিবেশবান্ধব নয়। এখানেও বিপত্তি আছে। ঢাকা চারপাশের নদীগুলো নোংরা। তাই এই পানি ব্যবহারের অযোগ্য। কাজেই আমরা পানি আনতে যাচ্ছি পদ্মা নদী থেকে, যা এখান থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে, মেঘনা নদী থেকে, যা ২৪ কিলোমিটার দূরে।’

কালের আলো/ জিকেএম/এমকে

Print Friendly, PDF & Email