মিত্রবাহিনীর শহীদ সেনাদের স্মৃতিস্মারক নির্মাণ হোক

প্রকাশিতঃ 10:47 am | December 19, 2022

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার :

১৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। ওই দিন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে যায়। জন্ম হয় একটি নতুন রাষ্ট্রের, লাল সবুজ পতাকার, বাংলাদেশের। বাংলাদেশের ওই জন্ম একদিনে হয়নি, এর রয়েছে সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম, মুক্তি চাই মুক্তি স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করা, সর্বশেষ ২৫ মার্চ কালোরাত্রির পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালিদের অস্ত্রহাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘটনার পরিক্রমায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

বাংলাদেশের ওই স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রথম থেকেই ভারত প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মায়ের ভাইয়ের ভূমিকা রেখেছে। ভারতের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ অসম্ভব ছিল। বাঙালি জাতি বাংলার মাটি তাই সবসময় ভারতের কাছে ঋণী।

অবশ্যই ভারতবিরোধী পাকিস্তানপন্থি বাংলাদেশের একদল ‘নব্য রাজাকার’রা প্রায়ই জাতিকে এই সবক দেয় যে ভারত তার স্বার্থে পাকিস্তানকে আলাদা করেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মদত জুগিয়েছে। স্বার্থ ছাড়া মা তার সন্তানকে দুধ খাওয়ায় না। সন্তানকে ভালোবাসায় মায়ের আনন্দ হয়। ওই নিজের আনন্দ লাভের জন্যই তার সন্তান প্রেম। সন্তান বড় হয়ে ওই আনন্দ লাভের ধোঁয়ো তুলে নিশ্চয় মায়ের ঋণ অস্বীকার করলে সমাজ ও রাষ্ট্র তা গ্রহণ করবে না। তেমনি ভারত যে স্বার্থেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে সাহায্য সহযোগিতা করে থাক না কেন এটাই চরম সত্য, বাংলাদেশের জন্মের ঋণ আছে ভারতের কাছে।

একাত্তরের ২৫ মার্চের কালোরাতে নিরস্ত্র নিরীহ ঘুমন্ত সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক রাতেই হাজার হাজার মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাট করে। ঘর ছাড়া হয় লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ। প্রাণভয়ে তারা ছুটে যায় সীমান্তের দিকে। ভারত সরকার ও তার জনগণের উদারতায় তারা ভারতে আশ্রয় পায়। আজকের ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের বাংলাদেশ ভারতের সীমান্তের কর্মকাণ্ড নিয়ে যত প্রশ্ন থাক না কেন, একাত্তরে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের ভিন্ন পরিচয় ছিল। ওই সময়ে বিএসএফের প্রতিটি সদস্য ছিল বাঙালিদের রক্ষাকর্তা। পূর্ব পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত খুলে দিয়ে তারা পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর প্রাণরক্ষা করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়ে পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১ কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। বিএসএফের সহযোগিতা ও সাহায্য ছাড়া ওই শরণার্থীদের পক্ষে ভারতে প্রবেশ করা সম্ভব হতো না।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র, অর্থ, প্রবাসী সরকারকে সদর দফতর স্থাপন করে কার্যক্রম পরিচালনা, শরণার্থীদের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের সংস্থান করার মধ্যেই একাত্তরে ভারতের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল না। তৎকালীন ভারত সরকার তার সেনাবাহিনীকে প্রেরণ করে পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যৌথভাবে লড়তে। তাই একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী লড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিটি রণাঙ্গনে। ভারত ও বাংলাদেশের ওই মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানে শত্রু মুক্তি হয় বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে রেসকোর্স বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম হয় একটি নতুন দেশের, নাম তার বাংলাদেশ।

ওই নতুন দেশের জন্মে বাংলাদেশের হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে ভারতের সেনারাও বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়েছে দেশকে স্বাধীন করতে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রণাঙ্গনে মোট ৩৬৩০ জন ভারতীয় সেনা শহীদ হয়েছে, নিখোঁজ সেনা সদস্যের সংখ্যা ২১৩ এবং ৯৮৫৬ জন সেনা সদস্য আহত হয়। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বুকের তাজা রক্তের সঙ্গে এই দেশের মাটিতে ভারতীয় সেনাদের রক্তও মিশে আছে। বিশ্বের ইতিহাসে অন্য দেশকে স্বাধীন করতে প্রতিবেশী কোনও দেশের সেনাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়ার উদাহরণ ইতিহাসে খুব বেশি নেই।

বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ক রক্তের ঋণে কেনা। বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের উচিত ওই সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করা। অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে বন্ধুত্বের সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়া। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক যে রক্তের ঋণে তৈরি হয়েছে তার প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরলেই কেবল ওই সম্পর্ক মিত্রতার ফ্রেমে এগিয়ে যাবে। আর ওই জন্য চাই একাত্তরে শহীদ বাংলাদেশ ভারতের সেনাদের স্মরণে স্মৃতিস্মারক।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছর পার করলেও বাংলাদেশ বা ভারত সরকার কেউ মিত্রবাহিনীর সেনাদের আত্মত্যাগের স্মৃতি স্মরণ করে মিত্রবাহিনীর নামে কোনও স্মৃতিস্মারক নির্মাণ করেনি। বাংলাদেশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে নানা বিষয়ে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক থাকলেও তারাও এক্ষেত্রে কোনও উদ্যোগ নেয়নি।

প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানাতে ফুল দেয়। একাত্তরের শহীদ সেনাদের স্মরণে বাংলাদেশের সেনানিবাসগুলোয় নানা আয়োজন থাকে। একই দিনে ভারতের সেনাপ্রধান ফোর্ট উইলিয়ামে ও ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়ালে ফুল দিয়ে একাত্তরের শহীদ ভারতীয় সেনাদের স্মরণ করে। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে মিত্রবাহিনীর সদস্যরা শহীদ হলেও দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশ ও ভারত উভয় পক্ষই স্বতন্ত্রভাবে যার যার শহীদ সেনাদের স্মরণ করে। তাই উভয়ের কার্যক্রমে মিত্রবাহিনী অনুপস্থিত। একাত্তরে যেসব ভারতীয় সেনা সদস্য শহীদ হয় তাদের মূল পরিচয় ভারতীয় বাহিনীর সদস্য হলেও আরও একটি পরিচয় হলো তারা মিত্র বাহিনীর সদস্য। ওই মিত্রবাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয় একাত্তরে।

বাংলাদেশেরও বহু মুক্তিযোদ্ধা ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে একই লড়াইয়ে শহীদ হয়। তাই ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের উভয়ের উচিত যৌথভাবে ওই মিত্রবাহিনীর সেনাদের স্মরণ করা। উভয় দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মিত্রবাহিনীর সেনাদের স্মরণে স্মৃতিস্মারক নির্মাণ করলেই তখন যৌথভাবে মিত্রবাহিনীর শহীদ সেনাদের ১৬ ডিসেম্বরে স্মরণ করা সহজ হবে।

তাই উভয় সরকারের কাছে একাত্তরের মিত্রবাহিনীর শহীদ সেনাদের স্মরণে বাংলাদেশ ভারতের সীমান্তে স্মৃতিস্মারক নির্মাণ করা এবং প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর উভয় দেশের জনগণ, সরকার ও সেনাবাহিনী ওই স্মৃতিস্মারকে একাত্তরের শহীদ মিত্রবাহিনীর সদস্যদের শ্রদ্ধা জানাতে পারে, সেই ব্যবস্থা করার দাবি জানাই। আর এমনটি করা সম্ভব হলে উভয় দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। রক্তের ঋণে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল একাত্তরে তা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় হাতে হাত ধরে আগামী দিনে এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আজ যে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছিয়েছে তা আমলে নিয়ে বলা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৫১ বছরের ব্যর্থতা ভুলে মিত্রবাহিনীর শহীদ সেনাদের স্মরণে স্মৃতিস্মারক নির্মাণের এখনই উপযুক্ত সময়। সংঘাতময় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মিত্রতার বন্ধনের দৃষ্টান্ত হবার যে সুযোগ বাংলাদেশ ও ভারতের হাতে রয়েছে, মিত্রবাহিনীর স্মৃতিস্মারক তার ভিত্তি হবে। ওই স্মৃতিস্মারক নির্মাণের মাধ্যমে আগামী বিজয় দিবসে মিত্রবাহিনীর শহীদ সেনাদের উভয় দেশ যৌথভাবে শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মরণ করলেই মিত্রবাহিনীর সদস্যদের একাত্তরের আত্মত্যাগের বীরত্বপূর্ণ কাহিনি বাংলাদেশ ও ভারতের তরুণ প্রজন্মকে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নতুন পথ দেখাবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

Print Friendly, PDF & Email