শেখ রাসেল: অদম্য আত্মবিশ্বাস ও দীপ্ত জয়োল্লাসের প্রতিচ্ছবি

প্রকাশিতঃ 12:23 pm | October 18, 2022

ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন :

ভারত ভাগের পর থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য বীর বাঙালির আত্মদান তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ব্যবধানকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। বাঙালির ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি আন্দোলনে অগ্রদূত ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৪ সালে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট আরও গভীর হয়। বাঙালির মুক্তির দাবি জোরালো হতে থাকে চতুর্দিকে। বাঙালির মুক্তির উষালগ্নে ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়ি আলোকিত করে জন্ম নেয় এক পবিত্র শিশু। রাসেল। ইতিহাস যাকে শেখ রাসেল নামে চেনে। রাসেল হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কনিষ্ঠ সন্তান এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদরের ছোট ভাই। সেদিন এই দেশে আরও অনেক শিশুই হয়তো জন্ম নিয়েছে। কিন্তু রাসেলের মতো নির্মম ভাগ্য হয়তো কাউকে বরণ করতে হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল রাতে শিশু রাসেলও ঘাতকের হাত থেকে রেহায় পায়নি। দেশ ও জাতির জন্য শিশু অবস্থায় নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হয় ছোট্ট শিশুকেও। শেখ রাসেলের শৈশবের জীবনাদর্শ অন্য শিশুদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।

অনন্য শিশু শেখ রাসেল
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শেখ রাসেল নামের পেছনে একটি ঘটনা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন নোবেলজয়ী দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। মূলত তাঁর নাম অনুসারে নিজের কনিষ্ঠ সন্তানের নাম রাখেন বঙ্গবন্ধু। তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল থাকায় পিতা-পুত্রের সঙ্গে সেভাবে দেখা-সাক্ষাৎ হতো না। বেশিরভাগ সময় কারাগারে গিয়ে বাবাকে দেখতে হয়েছে শিশু রাসেলকে। কনিষ্ঠ পুত্রকে নিয়ে ঐতিহাসিক গ্রন্থ কারগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভিতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে।’ রাসেল ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’ আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।’ শেখ রাসেলের জন্ম নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের ছোট রাসেল সোনা বইয়ে লিখেছেন, ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা কাকা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজো ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজো ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হয়েছিল রাসেল।’

স্কুল জীবন ও বেড়ে ওঠা
শেখ রাসেল ছোট থেকেই ভীষণ দুরন্ত স্বভাবের ছিলেন। দুরন্তপনার সঙ্গী হিসেবে তার ছিল একটি সাইকেল। যেটি নিয়ে প্রতিদিন বিকেলে বের হতেন। প্রতিদিন ধানমণ্ডির ৩১-৩২ পর্যন্ত চক্কর দিতেন। দেশের প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হওয়ার পরও বিশেষভাবে বাইরে ঘুরতেন না। এলাকার অন্যান্য ছেলেদের মতো খুবই স্বাভাবিকভাবে সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। এছাড়া তার আরেকটি শখ ছিল মাছ ধরা এবং পুনরায় মাছগুলো পুকুরে ছেড়ে দেওয়া। মাত্র ৪ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলে শেখ রাসেলের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রথম কিছু দিন পরিবার থেকে তাকে স্কুলে রেখে আসা হতো। কিন্তু ছোট্ট বেলা থেকে প্রখর মেধাবী হওয়ায় নিজেই স্কুলে যাবার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তখন নিজ থেকেই স্কুলে চলে যেতেন শিশু রাসেল। অন্যদিকে ঐতিহাসিক বাড়িতে বড় হওয়ার সুবাদে তার মধ্যে নানা মানুষের সঙ্গে মিশতে পারার এক অভাবনীয় ক্ষমতা তৈরি হয়েছিলো। সেটির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে স্কুলে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে অসংখ্য বন্ধু হয় তার।

১৫ আগস্টে রেহাই পায়নি শিশু রাসেল
পৃথিবীর বহু দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মতো এমন পৈশাচিক ও ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। নানা কারণে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটলেও একটি পরিবারের শিশুসহ সবাইকে হত্যার নজির বিরল। ১৫ আগস্টের সেই ভয়াল তারিখে শেখ রাসেল ছিল মাত্র ১১ বছরের শিশু। সেদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাসেলকে নিয়ে আত্মরক্ষার্থে আড়ালে যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ তাকে আটক করা হয়। শিশু রাসেল আতঙ্কিত হয়ে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব’। পরবর্তী সময়ে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দিন’। ‘মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী ও চাচা-সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে শেষপর্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় শিশু রাসেলকে। ছোট্ট বুক ব্যথায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয় তখন। যাদের সান্নিধ্যে স্নেহ-আদরে হেসে খেলে বড় হয়েছে তাদের নিথর দেহগুলো পড়ে থাকা দেখতে বাধ্য করেছিলো পাষাণ খুনির দল।

বেঁচে থাকলে নেতৃত্ব দিতেন
শেখ রাসেল ধানমণ্ডির যে বাড়িতে জন্ম নেন সেই বাড়িটি দেশের বড় বড় রাজনৈতিক আন্দোলনের সূতিকাগার। এই বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতাপূর্ব ও পরবর্তীকালে প্রায় প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, জড়ো হতেন বাড়ির সামনে। এ যেন প্রতিদিন খণ্ড খণ্ড মুক্তির মিছিল এসে জড়ো হয় ধানমণ্ডির ৩২-এ। এই মিছিল-সভা শিশু রাসেলের মনে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। ছোট অবস্থায় রাসেলের মধ্যে বিকশিত হতে থাকে নেতৃত্বের গুণাবলী। খেলাধুলা ভালোবাসতেন বলে আয়োজন করতেন নানা ধরনের খেলাধূলা। শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে এবারের জন্মদিনে তাঁর বয়স হতো ৫৮ বছর। হতেন একজন পরিণত ব্যক্তি। হয়তো হতেন তথ্য-প্রযুক্তি গবেষক। হয়তো হতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী গবেষক-অধ্যাপক। একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, বেঁচে থাকলে তিনি বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতেন। ১৫ আগস্টের বর্বরতা শুধু ছোট্ট শিশু রাসেলকেই কেড়ে নেয়নি বরং কেড়ে নেয় বাঙালির সম্ভাবনাময় নেতৃত্বকেও।

আমাদের শিশু-কিশোররাই আগামীর নেতৃত্বে আসবে। তাদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, কলা ও গণিতে (এসটিইএএম) পারদর্শী হতে হবে। শেখ রাসেলের নিষ্পাপ চেতনাকে শিশু-কিশোরদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। জীবন ও আদর্শ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণায় শিশুদেরকে উৎসাহিত করবে। জাতির পিতার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের শরীরের রক্ত কণিকায় প্রবহমান ছিল মানবিকতাবোধ। খুনিরা ছোট্ট রাসেলকে হত্যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে পৃথিবী থেকে নিঃশেষ করতে চেয়েছিলো। কিন্তু খুনিরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি, শেখ রাসেলের চেতনাকেও নিঃশেষ করতে পারেনি। শেখ রাসেলের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ুক পৃথিবীর সকল শিশুর জীবনে।

লেখক: অধ্যাপক; বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এবং পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল)। প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, আমরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন।

Print Friendly, PDF & Email