ময়মনসিংহে জলাবদ্ধতার ‘অভিশাপ’ নির্বাসনে, খাল পুনরুদ্ধারে তোড়জোড়
প্রকাশিতঃ 9:31 am | August 14, 2022

অনিক খান, ময়মনসিংহ:
একটু ভারি বৃষ্টিতেই তলিয়ে যেতো সড়ক ও ফুটপাত। পানি ঢুকে পড়তো বাসাবাড়ি ও মার্কেটেও। মাত্র ১০ মিনিটের বৃষ্টিতেই দুই থেকে তিনদিন পানির নিচে থাকতে হতো নগরবাসীকে। বর্ষা এলেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের পাশাপাশি নানা রোগজীবাণুতে আক্রান্ত হতো নগরবাসীকে।
জলজটের কারণে সড়কগুলোয় সৃষ্ট যানজটেও নাকাল হতে হতো ঘন্টার পর ঘন্টা। বছরের পর বছর চলছিল এমন জটিল পরিস্থিতি। জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পের পুরো অর্থেই জলে এমন গালগপ্পেই ভারী হতো নগরীর বাতাস।
সেই চিত্র এখন অনেকটাই উবে গেছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে দীর্ঘ মেয়াদী ও সমন্বিত পরিকল্পনার ফলে এখন আর বর্ষায় পানির নিচে তলিয়ে যায় না ময়মনসিংহ নগরী। সরেজমিন ও ময়মনসিংহ নগরীর নতুন বাজার, গাঙ্গিনারপাড় মোড়, মাসকান্দা, আকুয়া, ষ্টেশন রোড, ছোট বাজার, বড় বাজার, দুর্গাবাড়ী, কালিশংকর গুহ রোডসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এমন চিত্র।
মূলত সঠিক পরিকল্পনা আর সময়োপযোগী নানা পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে জলাবদ্ধতার ‘অভিশাপ’কে রীতিমতো নির্বাসনে পাঠিয়ে ছেড়েছে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন। কীভাবে দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিললো, এমন প্রশ্নের উত্তরে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র মো.ইকরামুল হক টিটু জানাচ্ছিলেন এমন-‘নগরীর অন্যতম প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা নিরসনে পুরোনো ড্রেন সংস্কারের পাশাপাশি নতুন আরসিসি ড্রেন, আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। এই দুইয়ে সাফল্য মিলেছে। একই সঙ্গে সার্বিকতানির্ভর উদ্যোগ এবং সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতার শেকল মুক্ত করার পদক্ষেপের সুফল মিলেছে।’

‘আমরা দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতার ক্ষত অনেকটাই সারিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় এখনও কমবেশি জলাবদ্ধতার সমস্যা রয়েছে, সেগুলো নিয়ে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এটি অব্যাহত থাকবে। আমরা আশাবাদী এই সমস্যারও সমাধান হবে। তবে জলাবদ্ধতাকে চিরতরে দূর করতে সম্মানিত নাগরিকবৃন্দকেও সচেতন হতে হবে। তাদের সহযোগিতাও একান্ত কাম্য’- যোগ করেন মেয়র টিটু।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে ইতোমধ্যেই প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৩ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ ড্রেন নির্মাণের ফলে ব্রহ্মপুত্র নদে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে। আরসিসি সড়কের মাঝখান বরাবর মাটির নিচ দিয়ে বড় আকৃতির পাইপ বসিয়েও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে নদে।
ফলে নগরীর নতুন বাজার, রামবাবু রোড, সিকেঘোষ রোড, দুর্গাবাড়ী রোড, গাঙ্গিনারপাড়, স্টেশন রোড, মহারাজা রোড, স্বদেশী বাজার, মেছুয়া বাজার, ছোট বাজার ও বড় বাজারসহ বাণিজ্যিক এলাকাগুলোর পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হচ্ছে। এখন নগরীর রেললাইনের উত্তর পূর্বাংশের বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকায় বর্ষায় জলাবদ্ধতার দৃশ্যমান কোনো ভোগান্তি নেই বললেই চলে।

একই সূত্র জানায়, নগরীর মিন্টু কলেজ থেকে বিপিন পার্ক স্টেশন রোড থেকে থানাঘাট পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ ড্রেন নির্মাণ, কাশবন আবাসিক এলাকার ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক নির্মাণ, নাটককঘর লেন থেকে ডিবি রোড হয়ে সেহড়াখাল পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপড্রেন ইত্যাদি নির্মাণের ফলে মূল নগরীর অভ্যন্তরে আর জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে না।
নগরীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকার ছোট ছোট সড়ক এবং গলিতে মাত্র কয়েক মিনিটের ভারী বর্ষণেই জলাবদ্ধতা দেখা দিলেও এখন সেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে নগরীর আকুয়া, লিচুবাগান, সেনবাড়ি, সেহড়া ডিবি রোড, মাসকান্দা, কলেজ রোড ও আউটার স্টেডিয়ামের উদাহরণ টানা যাক।
এক সময় ওইসব এলাকায় বর্ষায় একাধিকবার জলাবদ্ধতা দেখা দিতো। ছোট ছোট ওই সব সড়কে বৃষ্টি হওয়ায় ঘর থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে যেতো। টানা বৃষ্টি হলে তিন-চার দিন জলাবদ্ধতা থাকতো। এখন এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা নেই বললেই চলে, বলছিলেন নগরীর আউটার স্টেডিয়াম এলাকার দোকানি আসলাম মিয়া (৫০)।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাইপড্রেন নির্মাণের জন্য মেশিন দিয়ে মাটি খনন করে তলদেশে সমান মাটির ওপরেই গোলাকার (রিং) স্ল্যাবগুলো বসানো হচ্ছে। বালির ওপর স্ল্যাব বসিয়ে এবং স্ল্যাবের দুই পাশ বালি দিয়ে ভরাট করার ফলে ভবিষ্যতে যানবাহনের চাপে স্ল্যাবগুলো নড়েচড়ে ও উঁচু-নিচু হয়ে যাওয়ার বা ভেঙে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। সবক্ষেত্রেই মানসম্পন্ন কাজে জোর দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে একনেকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের অবকাঠামো উন্নয়ন ও নাগরিক সেবার উন্নয়নে ১ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। মূলত এই প্রকল্পের আওতায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প’র কাজ পুরোমাত্রায় চলছে।
সূত্র মতে, জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন। জলজট থেকে নগরবাসীকে মুক্ত করতে টেকসই সমাধানের পথে হাঁটছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র মো.ইকরামুল হক টিটু। তিনি নগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫ টি গুরুত্বপূর্ণ খালকে পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে টেকসই পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর ভেতর দিয়ে সেহড়া খাল, মাকরজানি খাল, গোয়াইকান্দি খাল, বগামারি খালসহ মোট ৫ টি খাল রয়েছে। এসব খাল আকুয়া খাল হয়ে সুতিয়া নদীতে গিয়ে মিশেছে। আবর্জনা ফেলার কারণে ওই খালগুলো দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছিল। বাসা-বাড়ির ময়লা-আর্বজনার ফলেই মূলত এগুলো ভরাট হয়েছিল। সিটি করপোরেশন খালগুলো পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ গ্রহণ করায় নিয়মিত সেগুলো পরিস্কার করা হচ্ছে। পাশাপাশি নগরবাসীর মাঝে সচেতনতা তৈরিরও কাজ চলছে।
সূত্র জানায়, খালগুলোতে পানি প্রবাহ পুরনো চেহারায় ফিরিয়ে আনতে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়েছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি ড্রেনেজ সিস্টেমও কার্যকর করার কাজও চলমান রয়েছে। খালগুলোতে পানিপ্রবাহ নিশ্চিতের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন চ্যানেল সচল করতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন মেয়র।
ময়মনসিংহ জেলা নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী নুরুল আমিন কালাম বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার জন্য একে অপরকে দায়ী করার একটি সংস্কৃতি চালু রয়েছে। সেক্ষেত্রে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন পুরোপুরি ব্যতিক্রম। নিজেদের সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে নগরীকে জলাবদ্ধতা মুক্ত করতে তাদের প্রয়াস সাফল্য পেয়েছে। সুপরিকল্পিত উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন অন্যান্য সবার জন্য একটি উদাহরণ হিসেবে নিজেদের দাঁড় করিয়েছে।’
কালের আলো/বিএস/একে