কার অনুভূতি নিয়ে কে খেলে?

প্রকাশিতঃ 10:37 am | July 31, 2022

আমীন আল রশীদ:

ধর্মের সঙ্গে অনুভূতির সম্পর্ক নিবিড়। কেন না সেই অনুভূতির ভেতরে আছে বিশ্বাস। মানুষ যা বিশ্বাস করে, সে বিষয়ে কোনও ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সে প্রস্তুত নয়। তার কাছে যুক্তিও মুখ্য নয়। কারণ তার বিশ্বাসের ভিত বেশ জোরালো। আর মানুষের মনে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত যত জোরালো হয়, সে তত বেশি ভীত হয়। এই ভীতি পরকালীন শাস্তির। অতএব, সে যখনই তার সেই বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ হতে দেখে কিংবা তার ধর্ম অথবা ধর্মের অবতারের সম্পর্কে কোনও বিরূপ মন্তব্য দেখে, সে ক্ষুব্ধ হয়। কারণ তার অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে বলে সে মনে করে এবং তখন এই আঘাতের জবাব দিতে চায়।

প্রশ্ন হলো, কার অনুভূতিতে কে আঘাত করে এবং ঠিক কোন পরিস্থিতিতে তার ধর্মীয় অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে বলে গণ্য হয়? রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন কী বলছে এবং ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাখ্যাই বা কী? তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, কে কখন কাকে কোন প্রক্রিয়ায় এবং কোন উদ্দেশ্যে কাকে উত্তেজিত করে এবং উত্তেজিত হয়ে কারা অন্যের বাড়িঘর ও উপাশনালয়ে হামলা চালায়? ধর্মীয় অনুভূতির অভিযোগ যদি সঠিক হয় এবং প্রচলিত আইনে যদি এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং তার সম্প্রদায়ের ওপরে সংগঠিত আক্রমণের হেতু কী এবং কারা এর পেছনে ইন্ধন জোগায়?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবার আগে সাম্প্রতিক কয়েকটি সংবাদ শিরোনামে চোখ বুলানো যাক।

১. ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে মন্তব্য: স্কুল শিক্ষকের ৮ বছরের কারাদণ্ড; বিডিনিউজ, ৫ জুলাই ২০২২।

২. বিজেপি নেতা নূপুর শর্মার সমর্থনে ফেসবুকে পোস্ট: নড়াইলে ছাত্র ও শিক্ষককে জুতার মালা; চ্যানেল টোয়েন্টিফোর, ১৮ জুন ২০২২।

৩. ধর্ম নিয়ে মন্তব্য: দণ্ডিত শিক্ষকের পরিবার এখনও ঘরছাড়া; ডয়েচেভেলে, ৬ জুলাই ২০২২।

৪. ‘ধর্ম অবমাননা’র অভিযোগে নড়াইলে হিন্দুদের বাড়িঘরে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ; আজকের পত্রিকা, ১৬ জুলাই ২০২২।

৫. ফেসবুকে ‘ধর্ম অবমাননা’র অভিযোগে নড়াইলে আবারও হামলা; নিউজবাংলা, ১৫ জুলাই ২০২২।

৬. নড়াইলে ‘ধর্মীয় অবমাননার’ পোস্ট দেয়ার অভিযোগে তরুণ গ্রেপ্তার; বিবিসি বাংলা, ১৭ জুলাই ২০২২।

৭. পালিয়ে বেড়াচ্ছেন জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করা অধ্যক্ষ; দৈনিক শিক্ষা, ২৮ জুন ২০২২।

এরকম আরও অনেক সংবাদ পাওয়া যাবে। তবে এখানে উল্লিখিত ঘটনা তিনটি, যার মধ্যে দুটির অকুস্থল চিত্রা নদীবিধৌত নড়াইল এবং অন্যটি নোয়াখালী। চিত্রা নদীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখের কারণ হলো, ১৯৪৭-এ দেশভাগের প্রেক্ষাপটে নির্মিত তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পারে’ (১৯৯৮) সিনেমায় একটি সংলাপ আছে এরকম: ‘চিত্রা নদী ছেড়ে স্বর্গে গিয়েও সুখ নেই।’

নড়াইলের সাম্প্রতিক দুটি অঘটনের পরে এ নিয়ে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভ শোতে ওই শহরের কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে কথা হয়। তারা প্রত্যেকেই এই ঘটনায় বিস্মিত এ কারণে যে, তারা ভাবতেও পারেননি অন্তত নড়াইলে কেউ কোনোদিন সাম্প্রদায়িক উসকানি দেবে এবং উসকানিতে উত্তেজিত হয়ে কেউ হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালাবে। কারণ শত বছর ধরে এখানে হিন্দু-মুসলমান অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করে আসছে। তাহলে ‘চিত্রা নদী ছেড়ে স্বর্গে গিয়েও সুখ নেই’ বলে যে মন্তব্য করেছিলেন সিনেমার শশীভূষণ সেনগুপ্ত (মমতাজউদ্দীন আহমেদ), সেই সুখ কোথায় গেলো? হিন্দু মুসলমানের সেই সম্প্রীতি কে বিনষ্ট করলো? তাদের স্বার্থ কী?

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১। ১৯৭১ থেকে ২০২২। এই দুটি সময়ের পরিক্রমায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন কি তাহলে শিথিল হলো? কেন এবং কীভাবে হলো? ১৯৪৭ কিংবা ১৯৭১-এর তুলনায় দেশে এখন শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তাহলে কি মানুষ যত বেশি শিক্ষিত হচ্ছে, তত বেশি অন্ধ হচ্ছে? তত বেশি সাম্প্রদায়িক হচ্ছে নাকি রাজনৈতিক অপশক্তি অধিকতর শক্তিশালী হয়েছে এবং তারা সাধারণ মানুষকে অনেক বেশি প্রভাবিত করতে পারছে?

মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি কি দিন দিন ঠুনকো হচ্ছে নাকি মানুষ প্রকৃত ধর্ম থেকে বিচ্যুত হওয়ায় তথা ধর্ম অনেক বেশি লৌকিকতায় পর্যবসিত হওয়ার ফলে মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়ছে? এইসব প্রশ্নের এক কথায় জবাব দেওয়া কঠিন। এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে গত অর্ধ শতাব্দী ধরে বাংলাদেশে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ঢাকতে ‘ধর্মকে বর্ম’ হিসেবে ব্যবহারের প্রসঙ্গেও নির্মোহ আলোচনা করতে হবে। সেই আলোচনাটি কে কোন প্ল্যাটফর্মে করবেন? কোন পরিচয়ে? এমন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে কিংবা ব্যক্তি অথবা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে এরকম একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুললেও রাষ্ট্র কি সেই নির্মোহ আলোচনা ও বিশ্লেষণ সহনশীলভাবে মেনে নিতে প্রস্তুত?

সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুক ও ইউটিউবে ধর্ম, বিশেষ করে ইসলামের বিভিন্ন রীতিনীতি, বিধান এমনকি মহানবীর (সা.) সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য এবং তার বিপরীতে ইসলামি চিন্তাবিদ নামে কিছু আলোচকের উগ্রবাদী ও উসকানিমূলক বক্তৃতাও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টে যে ভূমিকা রাখছে—সেটিও অস্বীকারের সুযোগ নেই। অর্থাৎ এক পক্ষ নেতিবাচক মন্তব্য করছে, আরেক পক্ষ তার বিরুদ্ধে কথিত ‘জিহাদে’ নেমে পড়ছে। কারো মধ্যে সহনশীলতা নেই। একজন ইট মারছে, আরেকজন পাটকেল ছুঁড়ছে। কিন্তু কোনও ধর্মই এই ধরনের বিষোদ্গার এবং তার প্রতিক্রিয়ায় আক্রমণকে সমর্থন করে না। স্বয়ং মহানবী (সা.) তার বিরুদ্ধে সমালোচনার জবাবে কাউকে আক্রমণ করেছেন, এমন নজির নেই।

সমস্যাটা তাহলে কোথায়? সমস্যা রাজনীতির। শুধু বাংলাদেশ নয়, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সারা পৃথিবীতেই ধর্ম হচ্ছে রাজনীতির বিরাট হাতিয়ার। ধর্মীয় ইস্যুতে মানুষকে যত দ্রুত প্রভাবিত ও উত্তেজিত করা যায়; ক্ষেপিয়ে তোলা যায়; ধর্মীয় ইস্যুতে যত দ্রুত মানুষের বাহবা পাওয়া যায়, আর কোনও বিষয়ে সেটি সম্ভব হয় না।

ধর্মীয় বিষয়ে মানুষের মধ্যে অনুভূতি যেহেতু প্রবল এবং এই বিষয়ে মানুষ যেহেতু সংবেদনশীল, ফলে ধর্মীয় কোনও গোষ্ঠী যখন কোনও দাবি-দাওয়া তোলে, রাষ্ট্র সরাসরি সেটি নাকচ করে দিতেও ভয় পায়। উপরন্তু এমন সব আইনি কাঠামো গড়ে তোলে, যাতে কেউ ধর্মীয় বিষয় নিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিভিত্তিক অ্যাকাডেমিক তর্কেরও সাহস না পায়।

ফেসবুকে ইসলাম নিয়ে করা একটি মন্তব্যের জেরে এ মাসের শুরুতেই তথ্য-প্রযুক্তি আইনের মামলায় নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চৌমুহনি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক দেবব্রত দাশ দেবুকে আট বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে চট্টগ্রামের একটি আদালত। ২০১৭ সালের অক্টোবর ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম নিয়ে একটি মন্তব্য করেন দেবব্রত দাশ। এরপর তার বিরুদ্ধে ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগ তুলে ৩১ অক্টোবর তার স্কুলের সামনে কিছু লোক মানববন্ধন করে। পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে (বিডিনিউজ, ৫ জুলাই ২০২২)।

তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ফেসবুকে একটি মন্তব্যের জেরে তাকে যেমন জেলে যেতে হয়েছে, তেমনই পালিয়ে বেড়াচ্ছে তার পরিবারও। ৬ জুলাই ডয়েচেভেলের একটি খবরে বলা হয়, দেবব্রত দাশ দেবুর পরিবার এখনও এলাকায় ফেরেনি। ছোট্ট দুটি সন্তানকে নিয়ে তার স্ত্রী আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান করছেন। ভয়-আতঙ্কে ঠিকমত কথাও বলতে পারছেন না।

প্রশ্ন হলো, ধর্মীয় অনুভূতির মানদণ্ড কী?

দণ্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারায় মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, উপাসনালয় ভাঙচুরের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে এবং শাস্তির বিধান উল্লেখ থাকলেও কী কী কারণে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ আনা যেতে পারে তা বলা নেই। ধর্মীয় অনুভূতির সংজ্ঞা কী হবে, সেটি বিলুপ্ত আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা এবং বহুল বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও স্পষ্ট নয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করিবার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যাহা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’

অন্যদিকে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৯৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনও ধর্মীয় স্থান বা সেখানকার কোনও বস্তু ধ্বংস করা, ক্ষতি করা বা অসম্মান করা ধর্মীয় অবমাননা হিসাবে গণ্য হবে। আইন বলছে, কোনও ধর্মীয় স্থানের ক্ষতি সাধন, অসম্মান করা, লিখিত বা মৌখিকভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা তৈরি, অসম্মান করার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় স্থানে অনধিকার প্রবেশ বা ধর্মীয় বাক্য বা শব্দের বিকৃতি ধর্মীয় অবমাননা বলে গণ্য হবে।

এখানেও এটি স্পষ্ট নয় যে, ঠিক কোন কথাটি বললে বা লিখলে সেটিকে ‘ধর্মীয় অনুভূতি আঘাত’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। তার মানে যে কোনও নাগরিকের যদি মনে হয় যে, আরেকজনের কোনও একটি কথার দ্বারা তার ধর্মীয় অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, তাহলে তিনি মামলা করে দিতে পারবেন। আইনের এই অস্পষ্টতাই ধর্ম অবমাননার গুজব তোলা এবং সেই গুজব ছড়িয়ে হামলা ও মামলার পথ প্রশস্ত করে। রাষ্ট্র সচেতনভাবেই এ ধরনের আইনে অস্পষ্টতা সৃষ্টি করে রাখে যাতে যেকোনও সময় যে কাউকে ধরা যায় এবং সেখানে অতি অবশ্যই তার রাজনৈতিক স্বার্থ থাকে। যে কারণে দেখা যায়, ধর্ম অবমাননা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে মামলা কিংবা বিচারের চেয়ে এরকম অভিযোগ তুলে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ বা পিটিয়ে হত্যার ঘটনা অনেক বেশি ঘটে। অর্থাৎ ধর্মীয় অনুভূতির আওয়াজ তুলে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা; সমাজের দুর্বল মানুষের ওপর আক্রমণ করে তাদের এলাকাছাড়া করে তার ভিটামাটি দখল করা; বাড়িঘরে হামলার সময় লুটপাট করা; তাদের মনে ভয়-ভীতি ছড়িয়ে দিয়ে সমাজে প্রান্তিক করে রাখা; ভোটের রাজনীতিতে তাদের ব্যবহার করাসহ নানাবিধ উদ্দেশ্য থাকে।

অস্বীকার করার উপায় যে, স্থানীয় পর্যায়ের যেকোনও আক্রমণ ও হামলা মামলার পেছনে সব আমলেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কোনও না কোনও পর্যায়ের নেতাকর্মীদের যোগসাজস থাকে। অনেক সময় তারা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সম্মতি আদায়ের জন্যও এইসব ঘটনায় নিজেদের যুক্ত করেন—যার পেছনে প্রধানত কাজ করে দখল, লুটপাট এবং ভোটের রাজনীতি। ধর্মীয় বিশ্বাস বা অনুভূতি সেখানে উসিলামাত্র।

এটি হচ্ছে ‍মুদ্রার একপিঠ। অন্য পিঠ হলো, ধর্মীয় বিষয় নিয়ে অনেকের খোঁচানোর স্বভাবও আছে। অনেকে অতি উৎসাহী হয়ে, নিজেকে অন্যের চেয়ে আলাদা বা অগ্রসর প্রমাণ করতে গিয়ে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে এমন সব মন্তব্য করেন বা লেখেন, যা মানুষকে ক্ষুব্ধ করে। কিন্তু ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কী ধরনের আলোচনার জন্য আমাদের সমাজ প্রস্তুত বা কতটুকু সমালোচনা সহ্য করতে পারে, সেই বাস্তবতাটি মাথায় রাখা দরকার।

যেহেতু এক বা একাধিক পক্ষ সব সময়ই ঘরপোড়ার মধ্যে আলুপোড়া দেওয়ার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে, ফলে ধর্মীয় ইস্যুতে কোনও কিছু লেখার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা দরকার, যাতে ওইসব পক্ষ এটিকে ইস্যু করে কোনও ধরনের উসকানি দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলা করতে না পারে।

ফেসবুকে কে কী লিখলেন, সেটা সবার দেখা কথা নয়। সবার ফ্যান ফলোয়ারও অনেক নয়। যেমন নোয়াখালীর যে শিক্ষক কিংবা নড়াইলের যে ব্যক্তির ফেসবুক আইডি থেকে ইসলাম ধর্মসম্পর্কিত মন্তব্যগুলো পোস্ট হয়েছে, তারা কেউই খুব খ্যাতিমান কেউ নন বা তাদের অনেক বেশি ফলোয়ার নেই। কিন্তু এরকম অতি সাধারণ মানুষের পোস্ট কী করে লাখ লাখ মানুষ জানলো?

তার মানে কেউ সচেতনভাবেই, পরিস্থিতি ঘোলা করার জন্যই ওই পোস্টগুলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। উসকানি দিয়েছেন। মানুষকে উত্তেজিত করেছেন। অতি উৎসাহী কেউ কেউ মানববন্ধনের ডাক দিয়েছেন। কেউ হয়তো তাদের সংগঠনকে যুক্ত করেছেন। কেউ কেউ সেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করেছে। কখনও এমনও হয় যে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস বা মন্তব্যকারীর সঙ্গে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে ধর্মীয় ইস্যুতে তার কোনও পোস্টের স্ক্রিনশট নিয়ে অনেক বেশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এখানে ধর্মীয় অনুভূতি বা বিশ্বাসের চেয়ে ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও রাজনীতি অধিকতর ক্রিয়াশীল থাকে।

যেহেতু ধর্মীয় বিষয় নিয়ে মানুষ স্বভাবতই সংবেদনশীল, সে কারণে ধর্মকর্ম না করা, এমনকি অসৎ ও দুর্নীতিবাজ লোকও নিজের ধর্মের বিষয়ে কোনও আপত্তিকর মন্তব্য শুনলে ক্ষেপে যায়। প্রতিক্রিয়া জানায়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরকম প্রতিক্রিয়ার পেছনে কাজ করে নানা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর উসকানি। যাদের কোনও না কোনও স্বার্থ থাকে। অতীতে অনেক ঘটনায় এরকমও দেখা গেছে যে, যার ফেসবুক আইডি থেকে ধর্ম অবমাননার কোনও পোস্ট দেওয়া হয়েছে, সেটি ওই ব্যক্তি নিজে লেখেননি। বরং তার আইডি হ্যাক করা হয়েছে। কিন্তু ভিকটিম হয়েছেন তিনি, তার পরিবার এমনকি তার সম্প্রদায়। সবশেষ নড়াইলে আকাশ সাহা নামে যার ফেসবুক আইডি থেকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তিমূলক পোস্ট ছড়ানো হয়েছে, সেটিও তিনি নিজে লিখেছেন কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়। অথচ তার আগেই সেখানে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেলো।

তাহলে সমাধান কী?

যেহেতু ধর্মীয় বিষয়ে মানুষের সংবেদনশীলতা বেশি এবং যেহেতু কিছু লোক সব সময়ই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার তথা ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার ধান্দায় থাকে, ফলে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও কিছু লেখার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্ক থাকা দরকার—যাতে কেউ ওই পোস্ট বা মন্তব্যকে পুঁজি করে ইস্যু বানাতে না পারে।

বাকস্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, যা খুশি তা-ই লিখতে হবে। অন্তত শিক্ষিত মানুষকে এ বিষয়ে বেশি সতর্ক থাকা দরকার। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কোন প্ল্যাটফর্মে কতটুকু বলা যাবে, সেই কাণ্ডজ্ঞানটিও থাকা দরকার। ফেসবুকের প্ল্যাটফর্ম ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুম বা গণমাধ্যমের নিউজরুম নয়। এখানে নানা শ্রেণিপেশার, নানা মত ও পথের এবং নানা ধান্দার লোক থাকে। অতএব কে কখন কোন কথাটিকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের শামিল বলে মনে করে উসকানি দেবে, তা বলা মুশকিল। ফলে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।

তবে এও ঠিক, আইনে ধর্মীয় অনুভূতি ও ধর্ম অবমাননার অস্পষ্টতা রেখে মানুষের মনের ভেতরে ফোবিয়া তৈরি করে রেখে একটি মুক্তমনা, যুক্তিপূর্ণ ও বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সুতরাং ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে এসব ঘটনা বন্ধ করার আগে প্রচলিত আইনি কাঠামোগুলো নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা এবং ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করাও জরুরি। রাষ্ট্রের নাগরিকরা কোন কথা বললে বা ঠিক কোন কাজগুলো করলে সেটি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বলে বিবেচিত হবে, সেটি আইনের দ্বারা সুস্পষ্ট করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কিছু লিখলেই বা কোনও মন্তব্য করলেই তাকে যাতে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে না হয়, সেরকম আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থাও থাকা দরকার।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

Print Friendly, PDF & Email