দেশে বন্যা এবং আমাদের উপলব্ধি

প্রকাশিতঃ 10:32 am | July 13, 2022

সিলভিয়া পারভীন লেনী:

করোনা মহামারির পর আরেকটি বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিজ্ঞতা নিলো দেশের মানুষ। বন্যার কারণে বিশেষ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামের মানুষের আর্তনাদ সমগ্র দেশবাসীকে আহত করেছে। এসব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও বন্যা পরবর্তী কষ্ট এখনও আক্রান্ত এলাকাবাসীর চোখে-মুখে।

এবারের বন্যার অভিজ্ঞতা কিছুটা ভিন্ন। ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ভারী বর্ষণের কারণে এলাকাটি এই মৌসুমেই চতুর্থবার বন্যার আশঙ্কায় রয়েছে। এই এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি বন্যা জীবন এবং জীবিকাকে ভয়াবহ ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এই এলাকায় হঠাৎ বন্যা অস্বাভাবিক কিছু না। হাওর এলাকাগুলো নিচু। এ কারণে মেঘালয় এলাকায় ভারী বর্ষণ হলে তা এসব এলাকা ভাসিয়ে দেয়। তবে সেই পানি সাধারণত খুব দ্রুত নেমেও যায়।

কিন্তু এ বছরের বন্যা একটু আলাদা। পানি খুবই ধীরগতিতে নামছে। এ কারণে দীর্ঘমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যেকোনও দেশের বন্যা ব্যবস্থাপনায় পানি খুব দ্রুত নদী-খালে নেমে যাওয়া নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু আমাদের নদী-খালগুলো পলিতে ভরে গেছে। খাল-নদীর মাঝখানে বানানো হয়েছে ভবন।

সুরমা এবং কুশিয়ারা নদী খননে প্রায় কোনও পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। শীতকালে সিলেট ভ্রমণে গেলে সুরমা নদীর মাঝে বিশাল বিশাল চর দেখা যায়। ফলে পানি যখন আসে তখন তা নদীর পাশের সব এলাকা ভাসিয়ে দেয়। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।

এসব এলাকার নদীগুলো এখন যৌবন হারিয়েছে। শীতকালে নদীর কিছু কিছু অংশে হেঁটেই পার হওয়া যায়। এ এলাকার পুরাতন নদী কালনি এবং বিবিয়ানা। এগুলোতো বাঁধ নির্মাণ করায় বন্যার পানি নেমে যেতে বাধা পাচ্ছে। এছাড়া অপরিকল্পিত রাস্তা, বাঁধ এবং বসতির কারণেও বন্যার পানি নেমে যেতে বাধা পাচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষ সীমান্তের ওপার থেকে পানি চলে আসার কারণে ভারতকে দোষারোপ করতে ভালোবাসে। কিন্তু পানির ধর্মই হচ্ছে নিচু ও নতুন এলাকা প্লাবিত করে দেওয়া। পানি কখনও কোনও দেশের মধ্যে বৈষম্য করে না।

এই বন্যার লক্ষণীয় দিক ছিল, খুব দ্রুত সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এর ফলে জীবন বাঁচাতে সবকিছু ফেলেই মানুষকে ঘরবাড়ি থেকে চলে যেতে হয়। মানুষ যা ফেলে যায় এর মাঝে খাবার, জীবিকার উপকরণ, পশুপাখি, ফসল এবং মাছের খামার ছিল। এর প্রায় সবই শেষ হয়ে যায়। এর মাঝে অসৎ মানুষের অসৎ ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি মানুষকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

নিত্যপণ্য মজুত করে অসৎ ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ফেলে। একটি ৫ টাকার মোমবাতি ১০০ টাকায়, গ্যাস সিলিন্ডার চার হাজার টাকার বেশি দামে কিনতে হয়। এমনকি যারা ত্রাণ দিতে গেছেন তাদের কাছেও কয়েকশ টাকার নৌকা ভাড়া ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করা হয়। আক্রান্ত এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সপ্তাহ ধরে ওই এলাকাগুলোতে মোবাইল নেটওয়ার্ক ছিল না। এর ফলে সারা দেশ থেকে বন্যাকবলিত এলাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দুর্গত বাড়িগুলোতে দুর্বৃত্তরা লুটপাট চালায়।

অনাকাঙ্ক্ষিত এই বন্যা মানবতার দৃষ্টান্তও দেখিয়েছে। তারকারা এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো কোটি কোটি টাকার ত্রাণ সংগ্রহ করে বন্যাকবলিতদের মাঝে বিতরণ করে। নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেও হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক ত্রাণ বিতরণে অংশ নেন। সেসব স্বেচ্ছাসেবকের প্রতি শ্রদ্ধা যারা বন্যাদুর্গত মানুষদের মুখে খাবার তুলে দিতে কাজ করেছেন। কিন্তু সরকারি ত্রাণ ছিল তুচ্ছ। এ কারণে মানুষ প্রবাসীদের দেওয়া অনুদান এবং বেসরকারি খাতের ত্রাণের পেছনে ছোটে।

ত্রাণ মূলত দেওয়া হয় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে। সেগুলোতে বন্যাদুর্গত মানুষ আশ্রয় পেয়েছিল। তবে এর ফলে প্রকৃত যারা বিপদে ছিল, আশ্রয় পায়নি, তারা বঞ্চিত হয়। পরিবহন খরচের কারণে ঘরে ঘরে গিয়ে ত্রাণ দেওয়া খুবই ব্যয়বহুল ছিল। এছাড়া ত্রাণ দেওয়া হয় রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত পছন্দের ওপর ভিত্তি করে। ত্রাণ দেওয়ার মানসিকতাও এর মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। কিন্তু কার ত্রাণ প্রয়োজন এবং কার প্রয়োজন নয়, তা আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া ভিন্ন ভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে কোনও ধরনের সমন্বয় ছিল না। যথাযথভাবে ত্রাণ বিতরণের জন্য নির্দিষ্ট এলাকার দুর্গত মানুষদের তালিকা তৈরি এবং ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের মাঝে সমন্বয় করা জরুরি ছিল।

দীর্ঘায়িত বন্যা মোকাবিলা করা খুবই কঠিন হতে পারে। সরকার যেহেতু অতীতে সফল হয়েছে তাই স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সরকারকেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। এই এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার সময় অবশ্যই ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনায় নিতে হবে। সরকারকে অবশ্যই এসব এলাকায় উড়াল সড়ক নির্মাণে কাজ করতে হবে।

সুন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা খুবই কষ্টসাধ্য হবে। এ কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়া সড়ক ও অবকাঠামো দ্রুত সংস্কার করতে হবে। কিছু মানুষ ঘরবাড়ি, জমিয়ে রাখা খাদ্যশস্য এবং ব্যবসার মূলধন হারিয়েছে। মাছের খামার ভেসে যাওয়া বড় ধরনের ক্ষতি করেছে। এসব মানুষ যাতে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেন সে লক্ষ্যে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। এ কারণেও আমরা সারা দেশে পরিচিত। আমার এখনও মনে পড়ে, আমি যখন শিশু ছিলাম তখন হাজারও মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ মেরামত করেছিলেন। নিজের এবং প্রতিবেশীর সাহায্যের চেয়ে ভালো সাহায্য দুর্যোগে আর কিছু হতে পারে না। একসঙ্গে আমরা বাঁচি কিন্তু আলাদা হয়ে গেলে ধ্বংস হয়ে যাই। এবারের বন্যা পরিস্থিতির উপলব্ধি যেন আমাদের আগামীর শিক্ষা হয়।

লেখক: সমাজ উন্নয়ন কর্মী ও উদ্যোক্তা।

Print Friendly, PDF & Email