গ্রাম বাংলার হারিকেন-কূপিবাতি এখন শুধুই অতীত স্মৃতি!
প্রকাশিতঃ 11:22 am | January 23, 2018
সুলতান আহমেদ, (মান্দা) নওগাঁ থেকে:
গ্রামীণ সমাজের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি সন্ধ্যা প্রদীপ হারিকেন-কূপিবাতি। “মনে প্রেমের বাত্তি জ্বলে বাতির নীচে অন্ধকার এ জীবনে চাইলাম যারে হইলোনা সে আমার….” বাতি নিয়ে লিখা এটি একটি গানের অন্তরা। সত্যিই বাতির নীচে ঘোর অন্ধকার।আলোর পরে আঁধার আসবে এটাই বোঝানো হয়েছে গানে গানে।
গ্রামীণ সমাজের প্রতিটি ঘরে ঘরে ব্যবহৃত আলোর বাহন ছিলো একমাত্র হারিকেন ও কূপিবাতি।তাও আবার হারিকেন সবার ঘরে ছিলো না। কারণ সাধ আছে সাধ্য নেই। এমন পরিস্থিতিও ছিলো এ সমাজের মানুষের ঘরে ঘরে। কিন্তু বর্তমানে এর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রতিটি ঘরের চিত্রটাই তেমনি পাল্টে গেছে দিব্যি। এখনআর কোন ঘরে কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হাজার বছরের ঐতিহ্যের বাহন সেই লণ্ঠন হারিকেন-কূপিবাতি নেই। এখন থেকে ২ দশক আগেও যেখানে বেশির ভাগ ঘরেই ব্যবহার হতো হারিকেন আর কূপিবাতি ২ দশক পরে এসে সেইরূপ এখন পুরোটাই পরিবর্তিত হয়েছে। তার সাথে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যের সেই লণ্ঠনগুলো। ২দশক আগেও চিত্রটি ছিলোএমন যে সারাদিনের কর্মব্যস্ততা সেরে সাঁঝের বেলায় মহিলারা ব্যস্ত হয়ে পড়তো সন্ধ্যায় ঘরেরআলো জ্বালানো নিয়ে। প্রতি সন্ধ্যায় হারিকেনের চিমনি খুলে, ধুয়ে মুছে সাফ করে ছিপি খুলে কেরোসিন তেল ঢেলে আবার চিপি লাগিয়ে রেশার মধ্যে দিয়াশলাই/ম্যাচেরকাঠি জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে তা নির্দিষ্ট সীমারেখায় রেখে ঘরের মেঝে জ্বালিয়ে রাখত।
৫-৬ ইঞ্চি লম্বা ও কিছুটা ছড়াকারের মত এক ধরনের কাপড় রেশা হিসেবে ব্যবহার করা হতো এতে। এটার আলো কমানো ও বাড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট একটি গিয়ার ছিলো। হাতেরসাহায্যে তা ঘুরিয়ে আলোর গতিবেগ কমানো ও বাড়ানো যেতো। রাতে ঘুমানোর সময় আলোকমিয়ে সারারাত হারিকেন জ্বালিয়ে রাখা হতো।
এছাড়াও কূপি বাতি ছিলো কয়েকপ্রকার। একনলা, দুইনলা, একতাক, দুইতাকের, পিতল ও সিলভারের। তবে সিলভার, টিন এবং মাটির তৈরী বাতিরব্যবহার ছিলো খুব বেশি। বাতির নলেআগুন জ্বালানোর জন্য রেশা হিসেবে ব্যবহার করা হতো ছেড়া কাপড়ের টুকরো কিংবা পাটের সুতলি। চিকন আর লম্বা করে ৫-৬ ইঞ্চির দৈর্ঘ্যের ওই রেশা বাতির নল দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতো। প্রতিদিন এর কিছু অংশ জ্বলে পুড়ে যেত। ফের পরের দিনআবার একটু উপরের দিকে তুলে দিতো। একপর্যায়ে তা পুড়ে গেলে আবার নতুন করে লাগানো হতো। বাজার থেকে ২-৫টাকায় ওই বাতিগুলো কিনতে পাওয়া যেত। কিছুদিন পর নীচ দিয়ে ফুটো হয়ে তেল পড়ে যেত। ফের নতুন একটি বাতি বাজার থেকে কিনতে হতো। এটা ছিলো মহিলাদের সন্ধ্যাবেলার দৈনন্দিন কাজের বিশেষএকটি অংশ। এই বাতি দিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করতো। এছাড়াও রাতের সকল কাজ, যেমন রান্না-বাড়া, কুটির শিল্প, হস্তশিল্প, ধান মাড়ানোসহ সকল চাহিদা মেটানো হতো এই আলো দিয়ে। রাতের বেলায় মহিলারা বেড়াতে গেলে প্রতিবেশী কিংবাআত্নীয়ের বাড়ি তাদের সঙ্গী ছিলো একটি হারিকেন। একজন হারিকেন ধরেসামনে হাঁটতো অন্যরা সবাই পেছন পেছন হাঁটতো। এছাড়াও গ্রামীণ প্রতিটি দোকানে সন্ধ্যা-রাতের প্রদীপ হিসেবে হারিকেন ও কূপিবাতির কদর ছিলো খুব বেশি। দোকানিরা কিংবা পথচারীরা রাতের বেলায় হাঁটা চলা করা কিংবা বাড়ি ফেরার পথের একমাত্র সাথী ছিলো হারিকেন। লণ্ঠনের আলোয় আলোকিত ছিলো যে জনপদ তা আজ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। সেই লণ্ঠনগুলোর প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে যাওয়ায় এগুলো এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না। তবে এখনো নৌকা কিংবা জাহাজে এর কদর একটুও কমেনি। এখনো রাতের বেলা নদীর দিকে তাকালে দেখা যায় লণ্ঠনের মিটমিট আলো জ্বলছে। জাহাজের পেছনের অংশে ব্যাকলাইট হিসেবে এখনো হারিকেনের যথেষ্ট ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া রিক্সার পেছনে এখনো হারিকেনের ব্যবহার চোখে পড়ে।
বর্তমানে গ্রামীণ সমাজের প্রতিটি ঘরে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়েছে। যেখানে ছিলোনা কোন বৈদ্যুতিক লাইট, পাখা, এয়ারকন্ডিশানসহ আরো অনেক কিছু। বর্তমানে বিদ্যুতায়নের ফলে সবকিছুর স্বাদ গ্রহণ করছে গ্রামীণ জনপদের বাসিন্দারা। এখন দিনের বেলায়ওআলো জ্বালাতেহয়। এখন আর শুধু বিদ্যুতেসীমাবদ্ধ নেই ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়ারজন্য আইপিএস (ব্যাটারিরসাহায্যে বিদ্যুৎসঞ্চয়) ব্যবহার করা হচ্ছে। কেউবা আবার সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। হাত পাখার বদলে বৈদ্যুতিক পাখা ও এয়ারকন্ডিশান ব্যবহার করা হচ্ছে।
গোপালকৃষ্ণপুর গ্রামের মৃতআকবর আলী মন্ডলের পুত্র মাহবুবুজ্জামান বলেন, হারিকেন আর কূপিবাতি ছিলো আমাদের জন্য আলোকবার্তা। এই হারিকেন আর কূপিবাতি যদি না থাকতো ওই সময় মানুষ খুব কষ্ট করতো। ঘরের সকল আসবাবপত্রের চাইতে এই দুটো জিনিস ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাইনয়, এগুলো ছিলো পরিবারের এক একটি সদস্যেরমত। সারাদিন এগুলোর প্রয়োজন না হলেও সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে এগুলোর কদর ছিলো খুব বেশি। কারো পরিবারে যদি তেলের একটু ঘাটতি থাকতো ওই পরিবারের রাতের সকল কাজ বন্ধ হয়ে যেতো। সন্ধ্যা ফুরালেই রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।
মান্দা উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের মিজানুর রহমানবলেন, এই হারিকেন-কূপিবাতি ছিলো আমাদের সভ্যতার বাহন। রাতের বেলায় আমরা এর যথেষ্ট ব্যবহার করতাম, সন্ধ্যা বেলায় আমরা এটার আলোয় পড়াশুনা করতাম। তাছাড়া কূপিবাতি পড়ার সময় খুব একটা ব্যবহার করা যেতনা ধোঁয়া ও কালিরজন্য। হারিকেনের চিমটি মোছারজন্য পালা করে একক দিনে একেক জনের উপর দায়িত্ব পড়তো। সব মিলিয়ে আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির স্মৃতিময় ঐতিহ্য, আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি ওই সময়ের মূল্যবান সম্পদ হিসেবে এই হারিকেন-কূপিবাতিএখনসময়েরআবর্তনের ব্যবহার বন্ধহয়েযাচ্ছে। এখন থেকে এগুলো স্মৃতির জাদুঘরে রূপান্তরিতহচ্ছে। আমরা চাই জাদুঘরে খুব যত্ন ও গুরুত্বের সাথে এগুলো সংরক্ষণকরা হোক। কারণ আধুনিকায়নের কাছে এগুলো এখন মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। আগামী প্রজন্মেরজন্য এগুলো ইতিহাস হয়ে থাকবে।
কালের আলো/এসএ/ওএইচ