অবহেলায় শ্রমিকের মৃত্যু: দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে
প্রকাশিতঃ 8:47 am | July 10, 2021

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো:
মগবাজারের দগদগে না শোকাতে না শোকাতেই রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের সেজান জুসের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে নিহত হলেন ৫২ শ্রমিক। যাদের বেশির ভাগই শিশু শ্রমিক।
আরও পড়ুন: ‘মাইয়ার লাশটা ফিরায়া দেন’
অভিযোগ উঠেছে, কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও কার্যত ব্যবস্থা না থাকার কারণে কারখানায় আগুন নেভাতে বিলম্ব হয়। এতে প্রাণহানিও ঘটে বেশি।
এমনকি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া এ ঘটনায় দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী শ্রমিক ও তাদের স্বজনেরা।
সম্প্রতি পুরান ঢাকার অগ্নিকাণ্ড, মগবাজার ও চট্টগ্রামে অগ্নিকাণ্ডে বহু মানুষ হতাহত হয়েছেন। রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বেঁচে ফিরে আসা শ্রমিক ও ফায়ার সার্ভিস বলছে— আগুন লাগার সময় ভবনের চতুর্থতলার সিঁড়ির গেট তালাবদ্ধ ছিলো। ফলে শ্রমিকরা বের হতে পারেননি। তালাবদ্ধ চতুর্থতলায় ৮০ জনের উপরে শ্রমিক কাজ করতেন। তাদের ভাগ্য কী ঘটছে তা এখনো অজানা।
এক্ষেত্রে কারখানার শ্রমিকদের অধিকার ও বিস্ফোরণ ব্যবস্থার তদারকি আরও বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, ক’দিন পরপর দুর্ঘটনার নামে শ্রমিক হত্যা বন্ধে সরকারের শ্রম ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরকে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে। শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। অঘটনে যারা মারা যাচ্ছে তাদের ক্ষতির যথেষ্ট পরিমাণ নিশ্চিত করতে হবে। শুধু নামকাওয়াস্তে নয়। দুর্যোগকালীন সময়ে যারা আমাদের সেবার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের পরিবারের বিষয়ে ভাবতে হবে। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দররক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ বলেন, আমাদের দেশে কারখানাগুলো আসলে কোনো কারখানা না, সবই একেকটা জেলখানা! কাজ করার পরিবেশ নেই। সুরক্ষিত ভবন নেই। নিরাপত্তা নিশ্চিতেরও ব্যবস্থা নেই।
‘এটি সম্পূর্ণ সরকারের দায়িত্বহীনতা। আমি বলব, একের পর এক কারখানায় যেভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে, শ্রমিকরা আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছে। এদের সবই খুন হয়েছেন। তার দায় সরকারকে নিতে হবে। কারণ, বিষয়গুলো দেখভাল করার জন্য সরকারের শ্রম অধিদপ্তর রয়েছে। তারা কী করছে? তাদেরও জবাবদিহিতা করতে হবে।’
তিনি বলেন, এর আগে আমরা দেখেছি শুধু রাসায়নিকের কারণে এ জাতীয় অনেকগুলো মৃত্যুমিছিল, সারা বিশ্ব দেখেছে। কার্যত কোনো সমাধান হয়নি। পুরান ঢাকার অগ্নিকাণ্ড, মগবাজারের অগ্নিকাণ্ড, চট্টগ্রামে অগ্নিকাণ্ডে শতশত মানুষ বলি হচ্ছে। মানুষ মরছে, একেকটা পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে। সরকার দায় নিচ্ছে না।
‘প্রত্যেকটি মৃত্যুর দায় সরকারের। মানুষের প্রাণ নিয়ে অনিয়মের জবাব সরকারকেই বহন করতে হবে,’ যোগ করেন এই শিক্ষাবিদ।
শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে—মন্তব্য করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এটি শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি হত্যাকাণ্ড! আমরা বারবার দেখছি, মানুষ শুধু আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছে কিন্তু আমরা এর থেকে কোনো শিক্ষা নিই না। এর থেকে বের হওয়ার পথ বের করি না। কেন আমরা শিক্ষা নিচ্ছি না? এগুলো সমাধানের জন্য সরকারের শ্রম ও বিস্ফোরক অধিদপ্তর রয়েছে, তাদের কাজ কী?
‘ আমি বলবো, তারা যদি তাদের কাজ না করতে পারে তাহলে এ সমস্ত অধিদপ্তর থাকার কোনো দরকার নেই। তারা কী করছে, তাদের কাজ জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। আর যদি না করতে পারে জবাবদিহি তবে তাদের পদ ছাড়তে হবে। কারণ মানুষের নিরাপত্তা, জীবনের শঙ্কা নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক (অব.) এয়ার কমোডর ইসফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, এটি মালিক কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, সুপারভাইজারের দায়িত্বহীনতা, যারা এটি দেখভাল করছেন তাদের দায়িত্বহীনতা। দরজা বন্ধ রাখা, তালা লাগিয়ে রাখা— ওদের কারণে মানুষের জীবন যেতে পারে না। আমরা এই সমস্ত ঘটনা বারবার দেখছি। এর থেকে কোনো শিক্ষা নিচ্ছি না। এ কারণে দেশের বাইরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দিন দিন নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার বিষয়টি প্রশ্ন হয়ে যাচ্ছে কূটনৈতিক পর্যায়ে। তাই বলবো, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর যারা সঠিক ব্যবস্থা ও দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না তাদের শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ‘
কারখানা মালিকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। যারা মারা যাচ্ছে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণ হতে হবে সে ক্ষতির পরিমাণ। শুধু নামকাওয়াস্তে নয়।
‘দুর্যোগকালীন সময়ে যারা আমাদের সেবার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের পরিবারের বিষয়ে ভাবতে হবে। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে,’ বলেন তিনি।
কালের আলো/ডিএস/এমএম