মামুনুলের গ্রেপ্তার : দেরিতে হলেও ধন্যবাদ

প্রকাশিতঃ 10:45 am | April 19, 2021

প্রভাষ আমিন :

মামুনুল হকের গ্রেপ্তারের খবরে আমার চট্টগ্রামের হাটহাজারী আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্বাধীনতা দিবস এবং পরের তিনদিনে সহিংসতায় নিহত ১৭ জন মানুষের কথা মনে পড়ছিল। আহারে, সেই ১৭টি পরিবারে নিশ্চয়ই এখন হাহাকার চলছে, ২৬ মার্চের আগেই যদি মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করা হতো, তাহলে তাদের স্বজন হারাতে হতো না।

সুনামগঞ্জের সেই সংখ্যালঘু গ্রামের মানুষ এখন নিশ্চয়ই আফসোস করছে, হায়, আগেই মামুনুল হককে ধরা হলে তারা এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন না। রয়েল রিসোর্টের মালিকের নিশ্চয়ই আক্ষেপ, এক মামুনুল হকের কেলেঙ্কারির কারণে তার এত সুন্দর রিসোর্টটি এভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতো না। বাংলাদেশের কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান নিশ্চয়ই এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন, যাক ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করার দিন বুঝি ফুরোলো। আর কেউ ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সন্ত্রাস চালাতে পারবে না, লাম্পট্য চালাতে পারবে না, মিথ্যা বলতে পারবে না, প্রতারণা করতে পারবে না। মামুনুল হককে আরো অনেক আগেই গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল। দেরিতে হলেও সরকার মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করায় সবাই এখন স্বস্তি পাবেন। সরকারকে ধন্যবাদ। বেটার লেট দ্যান নেভার।

মামুনুল হক দিনের পর দিন ঘৃণা ছড়াচ্ছেন, উস্কানি দিচ্ছেন এবং ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। মামুনুলরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, প্রগতির বিরুদ্ধে, প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে, নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। এরা বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রধান বাধা। তারা বাংলাদেশকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায়। তারা বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে বাধা।

মামুনুলকে আপাতত ২০২০ সালে মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা একটি ভাংচুরের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তবে মামুনুলের অপরাধের ফিরিস্তি অনেক লম্বা। শাপলা চত্বর, বায়তুল মোকাররম, হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, রয়েল রিসোর্টসহ দেশের বিভিন্নস্থানে হেফাজতের তাণ্ডবের মূল হোতা এই মামুনুল। দিনের পর দিন তিনি ইসলামের নামে ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়িয়ে আসছিলেন; তার উস্কানিতেই দেশের বিভিন্নস্থানে সহিংসতা হয়েছে, ভাংচুর হয়েছে।

মামুনুল হকের অপরাধ প্রমাণ করতে খু্ব বেশি সাক্ষী-সাবুদ লাগবে না। ইউটিউবের মামুনুল হকের অপরাধের অসংখ্য প্রমাণ আছে। তার কথা দিয়েই তার বিরুদ্ধে শত মামলা দেয়া সম্ভব। এতদিন মামুনুলের কথাবার্তা শুনলে যে কারো মনে হতে পারে, তিনি বুঝি আইনের ঊর্ধ্বে, তিনি বুঝি সমান্তরাল সরকার। যা ইচ্ছা তাই বলার অধিকার যেন তার আছে।

মামুনুলের মধ্যে সবসময়ই মনোযোগ কাড়ার একটা চেষ্টা আছে। উত্তেজক বক্তব্য দিয়ে নজর কাড়তে চান তিনি। ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের যে তাণ্ডব, তারও অন্যতম হোতা ছিলেন এই মামুনুল হক। তখনও তিনি সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে হুমকি দিয়েছিলেন। তখনও তাকে বঙ্গভবন, গণভবনে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়ার হুমকি দিতে দেখা গেছে। অনেক চেষ্টা করেও মামুনুল হক তখন আলোচনায় আসতে পারেননি। তখন হেফাজতের একক নিয়ন্ত্রণ ছিল আসলে আল্লামা শফির হাতে। আর সরকার আল্লামা শফির সাথে অশুভ আঁতাত করে হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে গতবছর বাবুনগরী গ্রুপের বিদ্রোহের মুখে বিনা চিকিৎসায় আল্লামা শফির মৃত্যুর পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট।

সরকারের সাথে হেফাজতের আঁতাত ভেঙ্গে যায়। হেফাজতের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় উগ্রপন্থি বাবুনগরীদের হাতে। আর বাবুনগরীকে হাত করে আবার আলোচনায় আসার চেষ্টা করেন মামুনুল হক। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে তিনি একের পর এক উগ্র এবং উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিয়ে মাঠ গরম করতে শুরু করেন। কোনো কিছুতেই কাজ না হওয়ায় মামুনুল বেছে নেন বঙ্গবন্ধুকে। মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতার নামে যে আন্দোলন শুরু করেন মামুনুল হক, তা অস্থিতিশীল করে তোলে গোটা দেশকে। মামুনুল যে ভাষায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিদ্বেষ ছড়াতে থাকেন, তা রীতিমত রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমণের প্রতিবাদে মামুনুল আবার মাঠে নামেন। উপলক্ষ্য মোদী হলেও মামুনুলের আসল টার্গেট বাংলাদেশ। মা্মুনুলের পিতা শায়খুল হাদিস আজিজুল হক স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন। মামুনুলরাও সেই আদর্শের ধারক। বাংলাদেশ গৌরবের সাথে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে, বিশ্বকে তাক লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের পথে; এটা মামুনুলদের পছন্দ নয়। তা্ই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজন বানচাল করতেই তারা ওঠে পড়ে লাগে। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজন রক্তাক্ত করাই তাদের লক্ষ্য হয়।

মামুনুলের হাত ধরে হেফাজতে অনুপ্রবেশ ঘটে জামায়াত-শিবিরের। মামুনুলের উস্কানিতে কর্মীদের ওপর হেফাজত নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ আলগা হয়ে যায়। শাপলা চত্বরে কর্মীদের রেখে পালিয়েছিল মামুনুলরা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজন বানচাল করতে মাদ্রাসার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পুলিশের গুলির মুখে ঠেলে দিয়ে মামুনুল ‘আমগোর শহীদুল ভাইয়ের ওয়াইফ’ নিয়ে ফুর্তি করতে চলে যায় রিসোর্টে। আবার রিসোর্টে ধরা খাওয়ার পর কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীকে সেখানে ফেলেই পালিয়ে আসে কাপুরুষ মামুনুল।

অনেকদিন ধরেই ইসলামের হেফাজত করার নামে হেফাজতে ইসলাম আসলে বাংলাদেশে ইসলামের ভাবমূর্তি ধ্বংস করে আসছিল। ইসলাম হলো শান্তির ধর্ম, ভালোবাসার ধর্ম। আর হেফাজত মানেই তাণ্ডব, ঘৃণা, সহিংসতা। শুধু তাই নয়; ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের অপকর্ম জায়েজ করার চেষ্টা করছিলেন মামুনুলরা। অনেক ধরেই এই অশুভ শক্তির মূল নেতৃত্ব ছিল মামুনুলের হাতে।

মামুনুল হক দিনের পর দিন ঘৃণা ছড়াচ্ছেন, উস্কানি দিচ্ছেন এবং ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। মামুনুলরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, প্রগতির বিরুদ্ধে, প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে, নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। এরা বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রধান বাধা। তারা বাংলাদেশকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায়। তারা বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে বাধা।

আমি অনেকদিন ধরেই মামুনুলকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে আসছি। তবে সরকারেরও কিছু কৌশল থাকে। মামুনুল হকদেরও কিছু রুহানী পুত্র আছে। যারা সুযোগ পেলেই তাণ্ডব সৃষ্টি করতে, সরকারি সম্পদ ধ্বংস করতে মাঠে নেমে পরে। একমাস আগে মামুনুলকে গ্রেপ্তার করা হলে তিনি হিরো হয়ে যেতে পারতেন। তার রুহানী পুত্ররা বলতে পারতেন, নরেন্দ্র মোদীর বিরোধিতা করেছেন বলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু আজকের মামুনুল নিছকই একজন লম্পট, প্রতারক, মিথ্যাবাদী, ইসলামের ভুল ব্যাখ্যাকারী, উস্কানীদাতা, ঘৃণা ছড়ানো দানব।

মামুনুলের সর্বশেষ ফেসবুক লাইভের পর অনেকের মোহভঙ্গ হয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছেন, মানবিক কারণে বিয়ের কথা বললেও তিনি আসলে জান্নাত আরা ঝর্নাকে বিয়েই করেননি। আর করলেও সেটা দুই বছর প্রথম স্ত্রীর কাছে গোপন রেখেছেন। চরম নৈতিক স্খলনের কারণে মামুনুল আজ এক ঘৃণিত ব্যক্তি। মামুনুলের অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সহিংসতার কারণে হেফাজতের অনেক সিনিয়র নেতাই সংগঠন ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সরকার এমন সময় মামুনুলকে আটক করেছে, যখন তার পাশে আর কেউ ন্ই। মামুনুল এখন সবার জন্যই বোঝা, এমনকি হেফাজতের জন্যও।

রয়েল রিসোর্ট কেলেঙ্কারির পর মামুনুল বারবার আল্লাহর কসম কেটে মিথ্যা কথা বলেছে। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ওপর গজব নাজিলের অভিশাপ দিয়েছেন। কিন্তু শকুনের দোয়ায় গরু মরেনি। উল্টো মিথ্যা কসম আর চ্যালেঞ্জ দেয়ায় গজব নেমেছে মামুনুলের ওপরই। সীমা লঙ্ঘনকারীকে আল্লাহও পছন্দ করেন না। মামুনুল অনেক আগেই সীমা লঙ্ঘন করেছিল। তার পাপের পেয়ালা পূর্ণ হয়েছিল অনেক আগেই। এবার তার দায় শোধের পালা।

মামুনুলের সরকার বিরোধী অবস্থান বা বক্তব্য নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। নরেন্দ্র মোদীকে আমিও অপচ্ছন্দ করি। নরেন্দ্র মোদীর সফরের প্রতিবাদের অধিকার বাংলাদেশের সবার আছে, মামুনুলেরও আছে। কিন্তু প্রতিবাদ আর সহিংসতা, তাণ্ডব, সরকারি সম্পদ ধ্বংস এক নয়। মামুনুলরা হলো ইসলামের শত্রু, দেশের শত্রু, প্রগতির শত্রু, অগ্রগতির প্রতিবন্ধক। মামুনুলের মত দানবকে বাইরে রেখে কিছুতেই দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। তাই শুধু মোহাম্মদপুর থানার ২০২০ সালের একটি মামলা নয়; তার সকল অপরাধ খতিয়ে দেখে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক।
১৮ এপ্রিল, ২০২১

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।